রহস্যের আগুনে ৭শ’ ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়েছেন

রহস্যময় আগুনে রাজধানীর গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন(ডিএনসিসি) পাকা ও কাঁচা মার্কেট ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আগুনে হাজার কোটি টাকার পন্য পুড়ে যাওয়ায় প্রায় ৭শ’ ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়েছেন।  সোমবার রাত দেড়টার দিকে কাঁচা মার্কেটে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। গতকাল রাত ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রনে আনে।

আগুন লাগার মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই তিন তলা কাঁচা মার্কেটটি ধসে পড়ে। এই মার্কেটের সঙ্গে লাগোয়া দুই তলা ডিএনসিসি পাকা মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই দুই মার্কেটের পূর্বদিকে গুলশান শপিং সেন্টারের বেশ কয়েকটি দোকানও পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ৯ টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনার কাজ শুরু করে। কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সবকটি গাড়ির পানি শেষ হয়ে যায়। ডিএনসিসি কাঁচা মার্কেটের পূর্বদিক প্রচন্ড শব্দে ধসে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের মোট ২৩ টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে আনার কাজ শুরু করে। গভীর রাতে এই আগুনের খবর পেয়ে ব্যবসায়ীরা ছুটে যান। তারা অভিযোগ করেন, পরিকল্পিতভাবে এই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ডিএনসিসি পাকা ও কাঁচা মার্কেটে ও গুলশান শপিং সেন্টার মিলে প্রায় সাড়ে ১০ বিঘা জমির ওপর মেট্রো গ্রুপ ও শান্তা ডেভোলপার লিমিটেড নামে দুইটি নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান এখানে ১৮ তলা মার্কেট কাম কমার্শিয়াল ভবন নির্মান করার কথা। এই নির্মান কাজ নিয়ে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সঙ্গে ডেভোলপার কোম্পানির পাল্টাপাল্টি মামলা রয়েছে। ২০০৮ সালে নির্মানের এই চুক্তির পর মার্কেটের স্থান খালি করে না দেওয়ায় ডেভোলপার কোম্পানি সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে একটি ক্ষতিপূরুন মামলাও করেছে। ডেভোলপার কোম্পানি ঐ মার্কেট খালি করে দেওয়ার জন্যই পরিকল্পিতভাবে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী ইত্তেফাকের কাছে অভিযোগ করেছেন।

তারা বলেছেন, আগুন ধরিয়ে দিতে গান পাউডার ব্যবহার করা হয়েছে। আগুনে প্রায় ৭শ’ দোকানের হাজার কোটি টাকার পন্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা এখন পথে বসেছেন। আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, সংসদ সদস্য একেএম রহমতউল্লাহ, আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া।

পরিকল্পিত কাজ! :মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ২৩ ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে আনার কাজ করছিল। কাঁচা মার্কেটের ধ্বংসস্তুপ থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। আর  দোতালা পাকা মার্কেটের প্রায় সবকটি দোকানের পন্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনের মেয়র আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘এ আগুন পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়ছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হবে। ফায়ার সার্ভিস ঠিক মতো কাজ করছে। আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে তাদের কোন গাফিলতি নেই।’ মঙ্গলবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে মেয়র আনিসুল হক বলেন, আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসুক, তারপর আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসবো। আমাদের কাছে কোনও আলাউদ্দিনের চেরাগ নাই যে সলিউশন হয়ে যাবে। আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস কাজ করবে।

গুলশান-১ নম্বরের ১১ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী সুমন অগ্নিকান্ডের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, রাত দেড়টার দিকে তিনি কাঁচা মার্কেটের ভিতর থেকে ধোঁয়া ও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখেন। আগুন আগুন বলে চিত্কার করে এগিয়ে যান। ঐ মার্কেটের নিরাপত্তা প্রহরীরা ছুটে আসেন। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। রাত ২ টার পর ফায়ার সার্ভিস এসে মার্কেটের সামনের দিক থেকে পানি দিতে শুরু করে। এরই মধ্যে তিন তলা কাঁচা মার্কেটের পূর্ব দিকের অংশ ধসে পড়ে। মূহুর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা প্রকান্ড আকার ধারণ করে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাকা মার্কেটের দোকানে।

ডিএনসিসির মার্কেটের ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, মধ্যরাতের আগুনে একাংশ ধসে পড়ার সঙ্গে প্রায় চারশ’ দোকান ও পাকা মার্কেটের প্রায় তিনশ’ দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। আরিফুল ইসলাম নামে এক জুয়েলারি ব্যবসায়ী হাহাকার করে বলেন, চোখের সামনে দেখলাম জীবিকার জায়গাটি পুড়ে পুড়ে ধসে পড়ছে। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিল। গুলশান কিচেন কর্নার দোকানের মালিক জাকির হোসেন মিয়াজী বলেন, দোকানের প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেচে। দোকানে রক্ষিত ৭০ হাজার টাকাও পুড়ে গেছে। সব মিলিয়ে তিনি আজ নিঃস্ব।

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ :ফায়ার সার্ভিসের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ টিপু বলেন, ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতির কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আগুন নেভানোর জন্য তাদের কোনো তত্পরতা চোখে পড়েনি। ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে মার্কেটের একদল ব্যবসায়ী ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর চড়াও হলে তারা সরে যান। প্রায় ১৫ মিনিট পর পানি নিয়ে নতুন করে আগুন নেভাতে শুরু করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সম্পর্কে ফায়ার সর্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, কাঁচা মার্কেট ধসে যাওয়ায় সেখানে পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণে মার্কেটের ছাদ ছিদ্র করে সেখানে পাইপ দিয়ে পানি দেয়া হয়। মার্কেটে কোন অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা তো ছিলই না, এর পাশাপাশি পানির কোন রিজার্ভ ট্যাংকও নেই যে যেখান থেকে ফায়ার সার্ভিস পানি সংগ্রহ করতে পারে। এ কারণে পানির স্বল্পতার কারণে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এ ব্যপারে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) আলী আহাম্মদ জানান, গুলশানে ডিএনসিসি মার্কেটের ভিতরে প্লাস্টিক, কসমেটিক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বিলম্ব হয়েছে। তাছাড়া  মার্কেটের ভেতর নিজস্ব কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে। তিনি আরও বলেন, মার্কেটের ভিতরে দাহ্য পদার্থ, কসমেটিক ও প্লাস্টিকজাতীয় জিনিস থাকার কারণেও আগুনের তীব্রতা বেশি ছিল।

মার্কেট নির্মানের চুক্তি: ২০০৮ সালে মেট্রো গ্রুপের সহযোগি প্রতিষ্ঠান আমিন এসোসিয়েটসের সঙ্গে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের একটি চুক্তি হয়। গুলশান ডিএনসিসি পাকা ও কাঁচা মার্কেটের সাড়ে ৭ বিঘা জমির ওপর দুইটি বেজমেন্ট ও ভূমির ওপর ১৮ তলা ভবন নির্মাণ করার কথা। চুক্তি অনুযায়ি নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান ৬৫ ভাগ ও সিটি কর্পোরেশন ৩৫ ভাগ স্থানের মালিক হবে। এ নিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সিটি কর্পোরেশন দোকান মালিকদের উচ্ছেদ করার নোটিশ দেয়। সম্প্রতি বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল মার্কেট দুইটি পরীক্ষা করে এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আদালতে সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। অপরদিকে, নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান ঐ জায়গা খালি করার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে চাপ দেয়। এ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন ও নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের করে। অপরদিকে, সাড়ে ৪ বিঘা জমির ওপর ছয় তলা বিশিষ্ট গুলশান শপিং সেন্টার নতুন করে নির্মান করার জন্য শান্তা গ্রুপের সঙ্গে ঐ জমির মালিক ফয়জুর রহমান চুক্তিবদ্ধ হন। গুলশান শপিং সেন্টারের মালিক সমিতির উপদেস্টা এস এম কাওসার অভিযোগ করেন, চুক্তি অনুযায়ি মার্কেটের মালিক নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একশ’ কোটি টাকা নিয়েছেন। এরপরই নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান দোকান মালিকদের সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এরই জের ধরে ১৩ মাস আগে নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান মার্কেটের বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগ কেটে দেয়। পরে এ বিষয়ে তারা আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত সম্প্রতি ওই মামলায় মার্কেটের দোকান মালিকদের পক্ষে রায় দেন।

দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত :ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত তা খতিয়ে দেখতে হবে। এজন্য শুধু ফায়ার সার্ভিসের ওপর তদন্তের দায়িত্ব দিলেই হবে না, পুলিশ ও দোকান মালিক সমিতির পৃথক তদন্ত কমিটি থাকা প্রয়োজন’। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, যদি পরিকল্পিত কোনো ঘটনা হয়ে থাকে বা তদন্তে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।