বাংলার আবহমানকাল ধরে কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী নদীর দু’পাড়ের মানুষ নানা ঘাত-প্রতিঘাত সংগ্রামের মধ্যে জীবন-জীবিুকার পথ খুঁজে নিয়েছে। অতিবাহিত জীবনে কত ধরনের আনন্দ-বেদনার কাব্য রয়েছে তা অনেকেরই অজানা। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলী নদীর পাড়ের মানুষের জীবনধারা বড়ই বৈচিত্র্যপূর্ণ। দেশের অন্য কোন অঞ্চলের মানুষের জীবনধারায় এ ধরনের বৈচিত্র্য আছে কিনা, তা চিন্তার বিষয়। কর্ণফুলীর দুই পাড়ে পাহাড়ি আদিবাসী চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা ছাড়াও আছে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের মধ্যে রয়েছে আবার আলাদা আলাদা গোত্র। গোত্রভেদে তাদের জীবন ধারায় রয়েছে ভিন্নতা। কর্ণফুলী নদীর দু’পাড়ের বিশাল এলাকা জুড়ে অসংখ্য সম্প্রদায় কিংবা জনগোষ্ঠির বসবাস রয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এখানে একেক সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী নিজেদের এলাকা ভাগ করে নিলেও তাদের মধ্যে কোন বিদ্বেষ কিংবা সংঘাত চোখে পড়ে না। কাপ্তাই বাঁধের নিচ থেকে কর্ণফুলী নদীর দু’তীর সরেজমিন ঘুরে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা আচার-আচরণে ব্যাপক বৈচিত্র দেখা গেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের যে সমস্ত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে বিভিন্নভাবে তা পালন করা হয়। তবে এই অনুষ্ঠানগুলো একেক জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায় একেকভাবে পালন করে। এখানকার মানুষের মধ্যে অনেক কৃষ্টি-কালচার যেমন, জন্ম-বিয়ে-পূজা-পার্বণ, নানা উপলক্ষ্যের অনুষ্ঠানাদি সাড়ম্বরে পালিত হয়। একই ধর্মাবলম্বী হলেও গোত্রের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে রয়েছে নানা আচার-আচরণ। তেমনি পূজা-পার্বণ আয়োজনে ব্যাপক ফারাক লক্ষ্য করা গেছে।
কর্ণফুলী নদীর তীরে বসবাসরত চাকমা আদীবাসীদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন কালের। ইতিহাসের মূল উপাত্ত খুঁজে পাওয়া না গেলেও খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীর দিক থেকে আদিবাসীদের কর্ণফুলীর তীরে বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বৈচিত্র্য এই জনগোষ্ঠির জীবন ও সংস্কৃতি যেমন চিরাচরিত ঐতিহ্যে লালিত তেমনি বর্ণিল ও নান্দনিক।
নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে, অন্যান্য আদি জাতিগোষ্ঠির মত চাকমারাও মঙ্গলীয় নৃ-গোষ্ঠিভুক্ত। কালের বিবর্তনে এবং ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় চাকমা রাজতন্ত্রের উত্থান-পতন, যুদ্ধ-সংঘাত, নানা চড়াই-উৎরাইয়ের কাহিনী থেকেও চাকমাদের আবাসস্থল ও বিভিন্ন রাজধানী স্থাপনের কথা জানা যায়। বার্মা ও মোগলদের সাথে যুদ্ধ সংঘাত এবং সম্পর্কের কারণেও চাকমাদের রাজধানী ও আবাসস্থল শঙ্খ নদীর তীরবর্তী হাঙ্গরকূলসহ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া হয়ে উত্তরের রাজাভুবন পর্যন্ত স্থায়িত্ব ছিল। পরবর্তীতে উত্তর পূর্ব দিকের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়। কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে কাপ্তাই, চিৎমরম, শীলছড়ি ও বারঘোনিয়া এলাকায় রয়েছে চাকমাদের বসবাস। তাদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সমাজ সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক ও সামাজিক বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। চাকমারা প্রাচীনকাল থেকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সমাজবদ্ধ জাতি।
কর্ণফুলী পাড়ের চাকমাদের আদিম পেশা ছিল পাহাড়ের ঢালে জুম চাষ। জুমে ধান, ভুট্টা, তিল, যব, ধনিয়াসহ বাহারি শস্যের চাষাবাদ হতো। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে পাহাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করে জুমের জমি প্রস্তুত করা হতো। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বীজ বুনে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ফসল ঘরে তোলা হয়। তবে এখন অতীতের জুম চাষের পেশা বদলে ফেলছে নদী তীরের চাকমারা। বর্তমানে তারা আধুনিক চাষাবাদের পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর জাতি হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে বসবাসরত চাকমারা তাদের পল্লীতে মাটি থেকে ৪-৫ হাত উঁচু করে গাছ বাঁশ দিয়ে এবং শন ও বাঁশের পাতায় চালা দিয়ে বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করেন। আধুনিক নির্মাণ শৈলী অনুসরণে বাড়িঘর করছেন চাকমারা। বাড়ির সামনে চাকমারা নির্মাণ করেন উঁচু মাচা। এটাকে তারা ইজর বলেন। ইজর ধান, তুলা, কাপড় ইত্যাদি রোদে শুকানো হয় এবং পানির কলসিসহ বিভিন্ন পাত্র রাখা হয়। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির গান, নাচ ও খেলাধুলা। চাকমাদের বাঁশ নৃত্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য। প্রেমের গানকে চাকমারা বলেন উবগীত। চাকমা তরুণ-তরুণীরা উবগীতের মাধ্যমে প্রেমের ভাষা বিনিময় করেন। ঘিলা খারা, নাদেং খারা, পত্তি খারা চাকমা সম্প্রদায়ের প্রিয় খেলাধুলা। সমাজে বিদ্যমান রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতির পোষাক পরিচ্ছদ। চাকমারা আদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাতি। তবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃতি, ভূত-প্রেত, দেবতা এসব বিশ্বাস করেন। তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হলো বিজু। সমাজের কারো মৃত্যু হলে মৃতদেহ শ্মশানে পোড়ানো হয়। তবে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে এবং শিশুদের মৃতদেহ মাটিতে কবর দেয়া হয়। চাকমা সমাজে মামাতো বোন, মাসিতো বোন, ফুফাতো বোন, দূরাত্মীয়ের ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় চুমুলাং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রংরা বিয়ের কার্য সম্পাদন করেন। চুমুলাং পড়ানোর সময় ছেলের পক্ষে সওদাগর ও মেয়ের পক্ষে পরমেশ্বরী দেবদেবীকে সাক্ষী রেখে ওঝা ‘জদন পানি আগেনি নেই’ বলে উপস্থিত নারী পুরুষের হুকুম চান। এসময় উপস্থিত লোকজন আগে… (আছে…আছে…) বলে রাংকে বিয়ে পড়ানোর স্বীকৃতি দেয়। চাকমাদের তান্ত্রিক শাস্ত্র খুবই সমৃদ্ধ। চাকমা সমাজে তন্ত্র-মন্ত্র এবং তাবিজ-কবজের ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বয়ন শিল্পের চাকমা রমণীদের খ্যাতি সমৃদ্ধ।
কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে রয়েছে মারমা জনগোষ্ঠির বসবাস। বিশেষ করে কর্ণফুলী তীরের কাপ্তাইয়ের চিৎমরম, শীলছড়ি, রাইখালী, ডলুছড়ি, বারঘোনিয়া, রামপাহাড় ও সীতাপাহাড় এলাকায় মারমাদের বিশাল জনগোষ্ঠির বসবাস। এই এলাকায় মারমা সম্প্রদায়ের বিশাল জনগোষ্ঠিকে ঘিরে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে একশ বছরেরও আগে গড়ে উঠেছে চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার ও বারঘোনিয়া নালন্দা বিহার। কর্ণফুলী নদীর পানি ব্যবহার করেই তাদের নিত্য আচার গোসলসহ ধোয়ামোছা চলে। খাবার পানিও আসে কর্ণফুলী থেকে। নদী পাড়ের মারমাদের সাথে কথা বলে জানা যায় তারা নিজেদের মগ পরিচয় দিতে অস্বীকার করে। তাদের মতে, মগ বলে কোন জাতি নেই। এটা অন্য জাতির খেতাব। মগ বলতে বুঝায় আরাকানি জলদস্যুদের। মারমাদের গায়ের রং ফর্সা এবং পায়ের গোড়ালি বড়। বার্মিজদের সাথে তাদের চেহারার মিল রয়েছে। গৌতম বুদ্ধের অনুশাসনই তাদের ধর্মের মূল মন্ত্র। এছাড়া প্রকৃতি পূজাতেও মারমারা বিশ্বাসী। কর্ণফুলী তীরের মারমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান, বুদ্ধ পূর্ণিমা, পানি খেলা ও থিনজিয়না অন্যতম। তাদের মধ্যে রয়েছে গোত্র বিভাগ। একই গোত্রের মাঝে তাদের সমাজে বিয়ে হয় না। প্রাচীনকাল থেকে মারমারা পাহাড়ে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি কর্মঠ। চাষবাষ ছাড়াও সংসারের প্রায় কাজ মেয়েদের উপর ন্যস্ত। তাদের সমাজে পুরুষরা অনেকটাই অপ্রধান। কর্ণফুলীর তীরের মারমা পল্লীগুলোতে দেখা যায় কাপড় বুনন ও চুরুট তৈরিতে বেশ পটু মেয়েরা। তবে মহিলা পুরুষ উভয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে অধিক গুরুত্ব দেন। মেয়েরা সাজগোজ বেশি পছন্দ করেন। চুলের খোঁপায় নানা রকমের ফুল ব্যবহার করেন মারমা মেয়েরা। মারমা মেয়ে পুরুষ উভয়ে পরনে লুঙ্গি ব্যবহার করেন। মেয়েদের পরনের লুঙ্গিকে বলা হয় থামি। মেয়েরা ফুল হাতা ব্লাউজ গায়ে দেয়। এগুলোকে তারা বলেন এনিজ্যি। বিচিত্র ধরনের কড়ি ও পুঁতির মালা ব্যবহার করেন মেয়েরা। মারমারা পরোপকারী ও অতিথিপরায়ণ। তারা পথিকের জন্য রাস্তার পাশে মাচাং ঘরে কলসি ভর্তি খাবার পানি রাখেন। বাংলা ভাষায় এটাকে জলটঙ্গি বলা হয়। মারমা সমাজে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর বন্দুক গুলি ছোঁড়া ও ঢাক-ঢোল পিটানো হয়। মারামাদের বিশ্বাস, বন্দুকের গুলি ও ঢাক ঢোলের শব্দে অপদেবতারা পালিয়ে যায়। এতে মৃতের আত্মার শান্তি পায়। মৃতদেহ তারা আগুনে পোড়ায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা অনেক আনন্দ করেন।
কর্ণফুলীর তীরে কাপ্তাই উপজেলার কয়েক অংশে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বসবাস। তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের সমাজে সনাতন প্রথা অনুযায়ী গাঙ্গা পূজা, মিত্তিনী পূজা, ক্যার পূজা, বুর পারা ইত্যাদিও কাল্পনিক দেব দেবীর পূজা পার্বণ প্রচলিত রয়েছে। এসব পূজা-অর্চনা যারা সম্পাদন করেন তাদের বলা হয় ওঝা। বুদ্ধ পূজা, সংঘ দান, সূত্র শ্রবণ, অষ্ট পরিষ্কার দান, প্রবারণা উৎসব, কঠিন চীবর দান, বুদ্ধ পূর্ণিমা, চক্রব্যূহ মেলা, জাদি পূজা প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কর্ণফুলী নদীর তীরের তঞ্চঙ্গ্যারা পালন করে থাকেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে তিনদিনব্যাপি বিজু উদ্যাপন করেন তারা। তঞ্চঙ্গ্যাদের কারো মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তির মুখে একটি রৌপ্য মুদ্রা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এ টাকা ভব নদী পারাপারের জন্য দেয়া হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তঞ্চঙ্গ্যারা বসবাস করেন উচু মাচাং ঘরে। জেইত ঘর, ভাতঘর, পিজোর, ও টংঘর সমন্বয়ে তাদের বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। কৃষির উপর নির্ভরশীল কর্ণফুলী তীরের তঞ্চঙ্গ্যারা মাছ ধরেন নদীতে। পাশাপাশি শাক সবজি ও ফলের বাগানসহ জুম চাষ করে জীবিকা চালান তঞ্চঙ্গ্যরা।
কর্ণফুলীর তীরের উভয়পাড়ে যেসব সম্প্রদায় বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে ওই এলাকা সেই সম্প্রদায়ের নামে পরিচিতি পেয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাকে বলা হয় বড়ুয়া পাড়া। এছাড়া ব্রাহ্মণ জনগোষ্ঠীর জন্য ‘ব্রাহ্মণ পাড়া’, জেলে জনগোষ্ঠীর জন্য জাইল্ল্যা বা জেলে পাড়া। তেমনি রয়েছে চাকমা পাড়া, মারমা পাড়া, রাখাইন পাড়া, গোয়াল পাড়া, মুচি পাড়া, হাড়ি পাড়া, কামার পাড়া, কুমার পাড়া, নাথ পাড়া, ধোপা পাড়া, নাপিত পাড়া, বারই পাড়ার মতো অসংখ্য পাড়া বা এলাকা।
দুর্গা পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও এদের মধ্যে একেক গোত্রের দুর্গা পূজা ছাড়াও অন্য অনেক প্রধান পূজা রয়েছে। আর সে গোত্রগুলো তাদের সে উৎসব বা পূজা জাঁকজমকভাবে পালন করে। যেমন জেলে সম্প্রদায়ের গঙ্গা পূজা, কামার সম্প্রদায়ের বিশ্বকর্মা পূজা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের গণেশ পূজা, গোয়াল সম্প্রদায়ের দেওয়ালী পূজা, গৃহস্থ পরিবারগুলো লক্ষ্মী পূজা এবং কার্তিক পূজা। এছাড়া কেউ কেউ অন্নপূর্ণা পূজা, কালী পূজা, বাসন্তী পূজা, জগধাত্রী পূঁজার আয়োজন করে থাকেন। বড়ুয়া সম্প্রদায়গুলো বৌদ্ধ পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা ছাড়াও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান তাদের খিয়াং বা বৌদ্ধ বিহারে ব্যাপক কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করে। তবে কর্ণফুলী তীরবর্তী চন্দ্রঘোনা এলাকার একমাত্র খ্রিস্টান পল্লীতে বছরের ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন ছাড়া অন্য কোন রীতিনীতি তেমন দেখা যায় না।
বর্ণপ্রথার কারণে কর্ণফুলীর দুই পাড়ের সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। অভিযোগ আছে নিুবর্ণের হিন্দুদের হয়রানি ও চরম নির্যাতন করেন উচ্চ বর্ণের হিন্দু দাবিদারেরা। তাদের এই বর্ণ প্রথার কারণে রাঙ্গুনিয়ার ইছাখালি জেলে পল্লীর বৃদ্ধ বংশী মোহন জলদাশ ক্ষোভের সাথে বলেন, বেশ্যা বাড়ির মাটি ছাড়া যেমন দুর্গা পূজা হয় না ঠিক তেমনি নিচু জাতের মানুষ না হলে ওই বড় জাতের মানুষগুলো চলতে পারে না। তারপরও তারা আমাদের ঘৃণা করে, অস্পৃশ্য বলে মনে করে। এদের কোন নিমন্ত্রণে গেলে সবার সাথে বসতে দেয় না, খাবার জায়গা হয় মাটিতে, সবাই বাসনে খেলেও আমাদের দেয়া হয় পাতায়।
একটি কথা প্রচলিত আছে নদী তীরবর্তী মানুষেরা অসম্ভব ধর্মভীরু। কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারাও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানকার সবাই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মন্দির প্রতি ভক্তি আস্থা পালন করে আসছে। এখানে হিন্দু ও বৌদ্ধরা মনস্কামনা পূরণের জন্য প্রার্থনা করে। তেমনি তাদের মন্দির, প্যাগোডা ও বিহার সংরক্ষণে সহায়তা করেন। কর্ণফুলী নদীর তীরের বাসিন্দাদের জীবনধারা লিখে শেষ করা যাবে না বলে জানিয়েছেন দুই তীরের বাসিন্দারা।
কর্ণফুলী নদী হয়ে কাপ্তাই পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নৃ- গাষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় মুল্যবোধের সৃষ্টি এবং ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল। মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, হিন্দু, বৌদ্ধ, খিস্টান ও প্রভৃতি জাতিসত্তা রয়েছে। এরা প্রত্যেক স্ব স্ব ধর্মীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে এসব ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে উঠেছিল।
কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী গ্রামের মানুষগুলো চির চঞ্চলা কর্ণফুলীর মতই প্রাণচঞ্চল। ফসল উৎপাদন ও অর্থনীতির গতি প্রবাহের সাথে সাথে সামাজিক ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি হয় এসব পাড়ের বাসিন্দাদের গ্রামগুলো। নদী পাড়ের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি, শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতির সাথে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় উপাসনালয় মন্দির গীর্জা, বিহার ও সুফী সাধকের মাজার। ইতিহাসের দিকে তাকালে জানা যাবে আরাকান ত্রিপুরা ও গৌড় এই তিন রাজশক্তির সময়ে অনেক ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে উঠলে বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর ভিন্নতা দেখা মেলে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে। প্রাচীন কালে এসব অঞ্চলে ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ কিলোমিটার নদীপথের দু’পাড়ে প্রায় ২৫টি ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে।
এরমধ্যে বোয়ালখালী উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী কালাচাঁদ ঠাকুর মন্দির, মেধাশ্রম মন্দির, চট্টগ্রামের সদরঘাট কালীবাড়ি, গঙ্গাবাড়ি, পাথরঘাটা গীর্জা, ও হিন্দুদের ধর্মীয় মন্দির উপাসনালয় রয়েছে। কর্ণফুলী নদী থেকে খুঁড়ে পাওয়া ভাগ্যবতী দেবীরূপী মৎস্য কুমারী রূপে আবির্ভূত। বর্তমানে ইছামতি নদীর পাশে গড়ে উঠেছে ইছামতি মন্দির। তাছাড়া এক হাজার বছর পূর্বে জাপানের সম্রাট আসিয়ানের সম সাময়িক বেতাগী কর্ণফুলীতে খুঁড়ে পাওয়া কষ্টিপাথরের মূর্তি যা বর্তমানে বেতাগী বৌদ্ধ মন্দিরে সংরক্ষিত আছে। কাপ্তাই থেকে রাইখালী বা চন্দ্রঘোনা পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের অংশে বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী চিৎমরম নামক স্থানে গড়ে ওঠে বৌদ্ধ ধর্মীয় উপাসনালয় ও বৌদ্ধ মন্দির।
স্থানীয় নাগরিক চন্দ্র (মার্মা) চৌধুরী ১৯০৫ সালে মার্মা অধ্যুষিত নিভৃত মায়াবী প্রকৃতি ঘেরা বিচ্ছিন্ন ও এই অবহেলিত চিৎমরম জনপদে পরবর্তীতে বার্মা নাগরিক ১৯২৭ সালে তার নিজ অর্থে বার্মা থেকে কাঠ ও নির্মাণ শিল্পী এনে কারুকাজের শৈল্পিক রূপ দিয়ে বৌদ্ধ বিহারটি পুনঃনির্মাণ করেন। চিৎমরমে রয়েছে শতবর্ষী বৌদ্ধ বিহার। এছাড়াও রয়েছে রাইখালি বাজারে ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দির, চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টিয়ান মিশনারি হাসপাতাল সংলগ্ন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপ্টিস্ট চার্চ বা গীর্জা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.