নববর্ষের প্রথম প্রহরে ভারতের বেঙ্গালুরুতে মেয়েদের ওপর প্রকাশ্যে যে ব্যাপক যৌন হামলা হয়েছিল, পুলিশ বলছে তার অনেক ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ তাদের হাতে এসেছে। কয়েকজন মহিলা দাবি করেছেন, সেই রাতে তারা বেঙ্গালুরুর নগর কেন্দ্রে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। তবে পুলিশের কাছে এ নিয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ দায়ের করেনি। ঘটনার শিকার এক নারী বিবিসিকে তার ওপর যৌন হামলার ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়েছেন। পেশায় মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ এই নারী কেবল পূজা নামে তার পরিচয় দিতে বলেছেন। পূজার কাহিনী: ‘৩১শে ডিসেম্বর রাতে আমি বেঙ্গালুরুর মহাত্মা গান্ধী রোডের একটি বারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আমি বার থেকে বেরিয়ে আসি একটা ফোন কল করার জন্য। তখন সবকিছুই বেশ শান্ত বলে মনে হচ্ছিল। সাড়ে বারোটার দিকে আমি আমার এক বন্ধুর ফোন পাই। আমাকে সেখান থেকে তুলে নেয়ার কথা ছিল ওর। কিন্তু আমার বন্ধু আমাকে জানালো, পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে ও আসতে পারছে না। ফলে শংকর নাগ থিয়েটারের কাছে ওকে মোটরসাইকেল পার্ক করতে হয়েছে। আমার বন্ধু আমাকে সেদিকে হাঁটতে বললো। আর ও আমার দিকে হাঁটা শুরু করলো। মাঝপথে কোথাও আমাদের দেখা হবে এটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। আমি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্রিগেড রোড ধরে হাঁটা শুরু করলাম। পথে আমি দেখলাম লোকজন হাঁটছে, ব্যস্ত পায়ে এদিক- সেদিক যাচ্ছে। বেঙ্গালুরুকে আমি খুব নিরাপদ শহর বলে জানতাম। কিন্তু এরপর যা ঘটলো তা দেখে আমি শিউরে উঠলাম। এটা যে শুধু আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে তা নয়। আরো অনেক মেয়ে একই ঘটনার শিকার হচ্ছিল। ওরা সবাই ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত। হঠাৎ একজন আমাকে ধাক্কা দিলো। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। আমাকে টেনে তুলবে এ রকম কাউকে আশ-পাশে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এরপর একদল মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। ওদের বন্ধুরা সবাইকে ঘিরে একটা বেষ্টনী তৈরি করলো যাতে মেয়েরা নিরাপদে হাঁটতে পারে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম ওদের সঙ্গে যেতে পারি কিনা। যখন আমরা একসঙ্গে এভাবে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখনো অনেক পুরুষ মানুষ আমাদের শরীরের এখানে সেখানে স্পর্শ করার চেষ্টা করছিল। যারা এই কাজ করছিল তাদের একজনের চেহারাও আমি মনে করতে পারি না। যখনই আমি এদের চেহারা দেখতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি তখনই তারা আমার শরীর হাতড়াচ্ছে বা আমাকে টানা-হেঁচড়া করছে। সেখানে এত লোক যে কে এই কাজ করছে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ব্রিগেড রোডে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো। তখন লোকজন নানা দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। আমার নিজের হাত পা আছে। আমি চাইলে তাদের ওপর হাত পা চালাতে পারি, ওদের চড়াতে পারি। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম না কে আমার শরীরে হাত দিচ্ছে। পানশালাতে যা ঘটেছিল: পানশালার ভেতরেও কিন্তু চলছিল একই ঘটনা। আমরা যখন ছয়-সাত হাজার রুপি খরচ করে একটা পাবে যাই নববর্ষ উদযাপন করতে, আমরা আশা করি যে সেখানে যারা আসবে, তারা অত্যন্ত সভ্য শ্রেণির মানুষ হবে। অন্তত এ রকম নীচ কাজ তারা করবে না। এরা তো নিরক্ষর বা অশিক্ষিত মানুষ নয়। ওরা বুঝতে পারে না যে একটা মেয়ের জীবনের ওপর এরকম একটা ঘটনার কী প্রভাব পড়তে পারে। সারাজীবনের জন্য এ ঘটনার দাগ থেকে যেতে পারে একটা মেয়ের জীবনে। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবো আমি? আমি তো কারও নাম জানি না, কারও চেহারা চিনি না। আমি যদি পুলিশের কাছে যাই তারাও জানতে চাইবে আমি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি। সেখানে এত লোক ছিল যে, পুলিশ ছিল তাদের তুলনায় খুবই কম। পুলিশের পক্ষে তো আর সবার ওপর নজর রাখা সম্ভব নয়। গত তিন দিনে এই ঘটনা একটা বিরাট ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কেন এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ওরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছে? হ্যাঁ, আমি এর আগেও এ রকম পরিস্থিতিতে পড়েছি। কিন্তু তখন আমি ঘুষি মেরেছি, চড় মেরেছি, কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছি। আমি বেঙ্গালুরুতে আছি তিন বছর ধরে। আমি ভেবেছিলাম এটা একটা নিরাপদ নগরী। এ রকম গণহারে মেয়েদের ওপর যৌন হামলার ঘটনা আমাকে হতবাক করেছে। আমি যখন লোকজনের সঙ্গে কথা বলি, তারা বলছিল, আগের বছরও নাকি এ রকমটাই ঘটেছে। তাহলে কেন কোন ব্যবস্থা আগে থেকে নেয়া হলো না? কিছুই ঘটবে না, এ রকম একটা ভান করার চেয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত এমন ঘটনা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া।’ (পূজার সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসি হিন্দির ইমরান কোরেশী)
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.