তিস্তা চুক্তি সই না হওয়ায় চলতি শুষ্ক মৌসুমেও তীব্র পানি সঙ্কটের কবলে পড়বে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজে পানির প্রবাহ দ্রুত কমতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার শুরু করায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। এই একতরফা পানি প্রত্যাহারের কবলে পড়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পরিস্থিতি এতটাই অমানবিক পর্যায়ে পৌঁছবে যে- তিস্তায় পানির প্রবাহ দাঁড়াবে ৩০০ কিউসেকে। তখন সেচের পানি না পেয়ে কৃষকের মাঝে দেখা দেবে হাহাকার। ফেব্রুয়ারিতে তিস্তার পানি সঙ্কট যখন দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষকে চরম ভোগান্তির দিকে নিয়ে যাবে, ঠিক সেই সময়টাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দিনক্ষণ নির্ধারণের প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রত্যাশা করে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরেও তিস্তার পানি চুক্তির বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের তালিকাতেই রাখা হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। একই কথা বলছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই চুক্তি সই না হওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে দোষারোপ করলেও বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই তিস্তা চুক্তি সই হচ্ছে না। সর্বশেষ চূড়ান্ত খসড়া অনুসারে, তিস্তার পানির ২০ শতাংশ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ছেড়ে দিয়ে ৪০:৪০ অর্থাৎ অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশ ও ভারত সমান ভাগ করে নেবে বলে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এটি এখন এমন অবস্থায় আছে, যে কোনো সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব। কিন্তু ভারত এটি ঝুলিয়ে দিতে নতুন করে তিস্তা নদী খনন করে পানি প্রবাহ বাড়ানোর প্রস্তাব রেখেছে। যা সময়ক্ষেপণেরই নামান্তর। এদিকে, তিস্তার পানি সঙ্কটকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা প্রকল্প এলাকায় সেচ যোগ্য জমির পরিমাণ ৬৬ হাজার হেক্টর থেকে কমিয়ে ১০ হাজার হেক্টর করেছে। উল্লেখ্য, গেল বছর তিস্তার পানি প্রবাহ ৩০০ কিউসেকেরও নিচে নেমেছিল। যা এ যাবতকালের সর্বনিম্ন রেকর্ড। গতকাল তিস্তায় পানি ছিল ১ হাজার কিউসেকের সামান্য উপরে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও তিস্তায় পানি প্রবাহ ৩ হাজার কিউসেকেরও কাছাকাছি ছিল। স্থানীয় কৃষি অফিস জানায়, পানি সঙ্কটের কবলে পড়ে তিস্তা সেচ প্রকল্পের ৫৬ হাজার হেক্টর জমি মালিক ধান চাষের পরিবর্তে ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকেছে। এতে করে যে উদ্দেশ্যে তিস্তা সেচ প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়েছে- তার মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হচ্ছে। বোরো মৌসুমে সেচ সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় একদিকে যেমন ধানের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে; অন্যদিকে ধানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্থানীয় কৃষকদের উপর। এ নিয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, সেচ খালগুলোতে সময় মতো পানি সরবরাহ করা সম্ভব না হলে চলতি শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় কমপক্ষে ৩শ’ কোটি টাকার বোরো ধান উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাউবো সূত্রে জানা যায়, উজানের পানির গতি এত দ্রুত কমছে যে, তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি সøুইস গেট বন্ধ রেখে সেচ খালে পানি প্রবেশ করানো হচ্ছে। স্থানীয় পাউবো কর্মকর্তার মতে, এখনই সেচ নিয়ে যে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে, এতে করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বোরো আবাদে কৃষকদের সেচ দেয়া নিয়ে তীব্র পানি সঙ্কটের কবলে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, তিস্তায় যে হারে পানি কমে আসছে, এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তীব্র পানি সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। তিস্তায় ভয়াবহ পানি হ্রাসের ফলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে সেচকাজের ব্যাঘাত ঘটবে। তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে সরকার ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে অতীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে একাধিকবার তিস্তা চুক্তির বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। ভারতের সাবেক এবং বর্তমান দুই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে এখন পর্যন্ত তিস্তা চুক্তিটি ঝুলে রয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.