সৌদি আরবপ্রবাসী রফিকুল ইসলাম (২৯), ওমানপ্রবাসী হারুনুর রশিদ (২৭), মালয়েশিয়াপ্রবাসী গোলাম হোসেন (৩১) ও কাতারপ্রবাসী বাসেদ মিয়া (৩৯)। ভাগ্য বদলানোর জন্য এই চার বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল ভিন্ন, তবে চারজনেরই লাশ দেশে এসেছে গত ডিসেম্বর মাসে। তাঁদের মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক)। এত কম বয়সে এমন মৃত্যু তাঁদের পরিবার মেনে নিতে পারেনি। এই চার যুবকসহ ডিসেম্বরে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মোট ২৬৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশি লাশ হয়ে ফিরেছেন। বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কে লেখা কারণ থেকে দেখা যায়, এঁদের ২১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে স্ট্রোক, দুর্ঘটনা, হৃদ্রোগ, অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে। সবচেয়ে বেশি ৪৪ জন মারা গেছেন স্ট্রোকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু দুর্ঘটনায়, ৪২ জন। হৃদ্রোগে মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। স্বাভাবিক মৃত্যু হয় ৫০ জনের। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ জন প্রবাসীর লাশ আসছে। ২০১৬ সালে মোট ২ হাজার ৯৮৫ জনের লাশ এসেছে, যা গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া গত বছর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৪২১ জনের এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৭৫ জন প্রবাসীর লাশ আসে। সব মিলিয়ে ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১ জনের লাশ আসে। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩০৭ জন। আর ২০০৫ সাল থেকে ধরলে গত বছর পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯৫৮ প্রবাসীর লাশ এসেছে। এ ছাড়া বিদেশে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর দাফন হয়েছে। সেই সংখ্যা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জানা নেই। প্রবাসীদের এমন অকালমৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনো কোনো অনুসন্ধান হয়নি। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাঁদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু আকস্মিক। প্রবাসী বাংলাদেশি, মৃতদের স্বজন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্ট্রোক ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপে ভোগেন তাঁরা। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের লাশ দেশে আনতে সহযোগিতা করে। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে দাফনের জন্য বিমানবন্দরে বোর্ড ৩৫ হাজার টাকা করে এবং পরে ৩ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান দেয়। কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া আসলেই কষ্টকর। যেহেতু প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে থাকেন, কাজেই দিনে ৮-১০ জনের লাশ আসাকে আমরা অস্বাভাবিক দেখি না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ দেখা যায় দুর্ঘটনা, স্ট্রোক বা হৃদ্রোগ। বিরূপ পরিবেশ, সব সময় চাপ—এসব কারণেই এমন মৃত্যু হতে পারে। এ কারণে এখন লোকজন বিদেশ যাওয়ার সময়ই আমরা তাঁদের সে দেশের খাবারদাবার, আইনকানুন সবকিছু সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি, যাতে তাঁরা সচেতন হতে পারেন।’ মধ্যপ্রাচ্য থেকেই ৬২ শতাংশ লাশ: ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে ১ হাজার ২৪৮ জন, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নয় বছরে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসা ২২ হাজার ৫৬১ লাশের মধ্যে ৬১ শতাংশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ২৯ শতাংশ (৬ হাজার ৫৮০ লাশ)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। এর সংখ্যা ৩ হাজার ৯৩৮। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ হাজার ৭৩৪ জনের, কুয়েত থেকে ১ হাজার ৩২২, ওমান থেকে ১ হাজার ৩১৮, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮৪৫, কাতার থেকে ৬০০, বাহরাইন থেকে ৫৯৯, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৫৯৭, সিঙ্গাপুর থেকে ৪৬৫, ইতালি থেকে ৪৯৫, যুক্তরাজ্য থেকে ২৮৭ এবং লিবিয়া থেকে ১৬৪ জনের লাশ এসেছে। বাকি লাশগুলো এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে। মেনে নিতে পারছে না পরিবারগুলো: ডিসেম্বরে লাশ আসা সাতক্ষীরার গোলাম হোসেন (৩১) জমিজমা বিক্রি করে দুই বছর আগে মালয়েশিয়া গিয়ে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। স্ট্রোকে তাঁর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্ত্রী বিলকিস আক্তার। চার বছরের একমাত্র সন্তান নিয়ে তিনি এখন অসহায় জীবনযাপন করছেন। গোলাম হোসেনের ভাই আয়নাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এত কম বয়সে কীভাবে স্ট্রোক করল তাঁরা আজও বুঝতে পারছেন না। আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত বছর হৃদ্রোগে মারা যান মোহাম্মদ মোজাহিদ (২৯)। তাঁর কৃষক বাবা জালালউদ্দিনও ছেলের এমন মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। ঢাকার কেরানীগঞ্জের নুরুল হক (৩৬) এক দশক ধরে সৌদি আরবে ছিলেন। হঠাৎ গত মাসে স্ট্রোকে তিনি মারা যান। ছোট চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী নূরজাহান। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী কারখানায় কাজ করতেন। হঠাৎ করে কেন মারা গেলেন, তিনি জানেন না। মানিকগঞ্জের কিতাব আলী (২৮), চট্টগ্রামের নাসিরউদ্দিন (২৯), নওগাঁর আরিফুল ইসলাম (৩২), ভোলার মজিদ মিয়া (৩২), কুমিল্লার আবদুল জলিলসহ (২৫) প্রায় সবার পরিবারের একই দশা। প্রবাসে স্বজনের অকালমৃত্যু তাঁদের অকূলপাথারে ভাসিয়েছে। পেশায় চিকিৎসক, দীর্ঘদিন সৌদি আরবপ্রবাসী এবং জনশক্তি রপ্তানিকারক আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে প্রচণ্ড গরম। এখানে খাবার খুব সস্তা ও তেলযুক্ত। পাশাপাশি দুশ্চিন্তা, মালিকের অত্যাচার, দেশে স্বজনদের নানা চাহিদা, বিনোদনহীন একঘেয়ে জীবন তাঁদের মানসিক চাপে ফেলে। এ রকম অবস্থায় অনেকে স্ট্রোক বা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। অনেকে দুর্ঘটনায় মারা যান।’ অভিবাসনবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, একাকী প্রবাস জীবন, সব সময় দুশ্চিন্তা, কাজের ও থাকার নিম্ন পরিবেশ—এসব কারণে মধ্যবয়সেই একজন প্রবাসীর জীবন থেমে যায়। সময় এসেছে এসব মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখার। পাশাপাশি বিদেশের কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় আলোচনার প্রয়োজন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.