‘সিডরেও এমন ক্ষতি হয়নি আমাদের। এই বন্যা আর ঝড়ে সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। সবজি গেছে, মাছ গেছে, বাড়ি-ঘর তলিয়ে গেছে পানিতে। এখন আর বেঁচে থাকার মতো কোনো পথ খোলা নেই। সুদে-কর্যে দেনা হয়ে মাছ চাষ করেছি সব বন্যায় ভেসে গেছে। এখন পাওনাদারদের হুমকির মুখে হয় বউ-বাচ্চা নিয়ে রাতের অন্ধকারে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে, না হয় স্বপরিবারে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ পর্যন্ত কেউ আমাদের খবর নিতে আসেনি, মেলেনি কোন ত্রাণ-সহায়তা’। এভাবে চরম হতাশার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার পারডুমুরিয়া গ্রামের চিংড়ি চাষি রাজেশ্বর বিশ্বাস। শুধু রাজেশ্বর নয়, এমনই হতাশা আর উদ্বেগের কথা জানালেন, এলাকার অধিকাংশ চিংড়ি ও সবজি চাষি। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সমুদ্র উপকূলীয় বাগেরহাটের চিতলমারীতে গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণ ও ঝড়ের আঘাতে উপজেলার বড়বাড়িয়া, হিজলা, কলাতলা, শিবপুর, চরবানিয়ারী, সন্তোষপুর, চিতলমারী সদরসহ ৭ ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার ৫শ’ মৎস্য ঘের, দেড় হাজার পুকুর, শতাধিক হেক্টর সবজি ক্ষেত পানির তোড়ে ভেসে গেছে। এছাড়া অসংখ্য বাড়ি-ঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গাছ-পালা, রাস্তা-ঘাট বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ স্থানে ঝড়ে গাছপালা ভেঙে পড়ে এখনো এলাকার বেশির ভাগ সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। বিশুদ্ধ পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়ছে। সর্বস্ব হারিয়ে শ’ শ’ পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় এখন পর্যন্ত এসব মানুষের কাছে কোনো প্রকার সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ-সহায়তা পৌঁছায়নি। এছাড়া এলাকার জন প্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিদর্শন না করায় ক্ষতিগ্রস্তরা চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। সিডরের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যাগ বলে এলাকার অনেকে এটিকে উল্লেখ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে বন্যা কবলিত এলাকায় নদী-খালে দেখা দিয়েছে মাছের মড়ক। সর্বত্র এলাকার চিংড়ি ঘের ও নদী-খালে মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এতে পরিবেশ দূষণ হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এলাকার অধিকাংশ চাষি সুদে-কর্যে ও বিভিন্ন ব্যাংক এনজিও থেকে টাকা এনে চিংড়ি চাষে ব্যয় করে এখন বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে তারা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। ঋণ শোধ দেয়ার মতো কোনো উপায়ন্ত দেখছেন না তারা। এ পরিস্থিতিতে পাওনাদারদের হুমকির মুখে অনেকে ঘরছাড়া রয়েছেন। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ দেখছেন না তারা। উপজেলার কুড়ালতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শাহাজান শেখ, কৃষ্ণপদ বাড়ৈ, নৃপেন বাড়ৈ, মনিন্দ্রনাথ মজুমদার, চপলা মজুমদার, সুদেব বাড়ৈ, তুলশী মজুমদার, বিনয় মজুমদার, সত্যেন মজুমদার, গোবিন্দ মজুমদার, শুরশাইল গ্রামের মানু শেখ, রানু শেখ, ওয়াদুদ বিশ্বাস ও কুরমনি গ্রামের পত্রিকা হকার আবুল কালামসহ ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য মানুষ জানান, ঝড়ে তাদের বসত বাড়িসহ যাবতীয় জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে তারা এখন খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছেন। সুড়িগাতি গ্রামের চিংড়িচাষি পলাশ বিশ্বাস, শ্রীরামপুর গ্রামের সাংবাদিক শেখর ভক্ত, পাটরপাড়া গ্রামের মুজিবর বিশ্বাস, শ্যামপাড়া গ্রামের স্বপন মণ্ডল, সত্যজিৎ রানা, পরিতোষ মণ্ডল, সুরশাইল গ্রামের মুন্না শেখ, কুরমনি গ্রামের রেজাউল খান, নির্মল বাইন, হরেকৃষ্ণ বিশ্বাসসহ শ’ শ’ চাষি জানান, প্রবল বর্ষণে এলাকার সকল মৎস্য ঘের ভেসে গেছে। ঘেরের পাড়ে নেট, বাঁশের বেড়া, দিয়ে চেষ্টা করেও ঘেরের মাছ শেষ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সবই ভেসে গেছে। হিজলা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড সদস্য জীবন কৃষ্ণ বাড়ৈ ও চিংড়িচাষি নাজমুল শেখ জানান, এ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ৯৮ বন্যা ও সিডরকেও হার মানিয়েছে। এতে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তরা উঠে দাঁড়ানোর সুযাগ নেই। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনোয়ার পারভেজ জানান, প্রবল বর্ষণ ও ঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে। সরকারি ত্রাণ-সহায়তা পাওয়া গেলে সেটি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.