ছোটবেলায় আমার ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ‘বউ’ হব! এমন অদ্ভুত শখ মাথায় চেপেছিল বড় আপুদের (কাজিন) বিয়ে দেখে। মনে হতো ইশ্, আমিও কবে ওদের মতো বড় হব! বউ সাজব। অনেক গয়না পরে বসে থাকব, সবাই আমার ছবি তুলবে। তখন কি আর জানতাম, সোনার গয়নার চেয়ে সোনার মেডেলের দাম অনেক বেশি! ‘বউ’ না সাজলেও যে লোকে ছবি তুলতে আসে, সেটাও আমার জানা ছিল না।
ভারোত্তোলনে আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। জুনিয়র ভারোত্তোলনে কয়েকটা প্রতিযোগিতায় দেশের জন্য পদক এনেছি। ২০১৫ সালেও কমনওয়েলথ জুনিয়র ও যুব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছি। কিন্তু ২০১৬ সালটি আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বললে নিশ্চয়ই ভুল হবে না। ভারতের গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জেতার পরই তো হঠাৎ সব বদলে গেল। ২০১৬ সালের শুরুতে কজনই বা আমাকে চিনত? অথচ ২০১৭-এর শুরুতে এসে নিজেই নিজের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হচ্ছি।
একটা বছর, স্রেফ একটা বছরই মানুষের জীবনটা বদলে দিতে পারে। এটা আমি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করি। আপনি হয়তো একটা একঘেয়েমি নিয়ে বছরটা শুরু করেছেন। পড়ালেখা কিংবা ক্যারিয়ারের দুরবস্থা হয়তো আপনাকে খুব ভোগাচ্ছে। কে জানে, ২০১৭ হয়তো আপনার জয়ের বছর হবে। আপনিও হয়তো আগামী বছরের শুরুতে গিয়ে নিজেকে নতুন করে চিনবেন।
আমি কে ছিলাম? কী ছিলাম? খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগ বস্তিতে থাকতাম। টাকার অভাবে ক্লাস সেভেনে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল (এখন অবশ্য উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি)। বক্সিং কোচ মামা শাহাদাত কাজী একরকম জোর করেই ভারোত্তোলন খেলতে নিয়ে এসেছিলেন। খেলার জন্যই পরে আনসারে চাকরি পেয়েছি। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। জীবন যদি আমার জন্য এত চমক রাখে, নিশ্চয়ই আপনার জন্যও কিছু না কিছু চমক রেখেছে। এখন শুধু সেটা খুঁজে নেওয়ার পালা।
হতাশ হয়ে অনেকে বলে, ‘ফাটা কপাল আমার। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ শুনে আমি হাসি। ‘ফাটা কপাল’ লোকের জন্য দুর্ভাগ্যের প্রতীক হতে পারে, আমার জন্য আশীর্বাদ। ২০১১ সালে একবার ভারোত্তোলন করতে গিয়ে মাথা ফেটে গিয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘যেই খেলা খেলতে গিয়ে মাথা ফাটে, সে খেলা আর খেলার দরকার নাই।’ কিন্তু আমার উল্টো জেদ চেপে গিয়েছিল। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, যেই খেলা খেলতে গিয়ে রক্ত গেছে, সেখান থেকে কিছু না নিয়ে ফিরব না। এরপর থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেতে শুরু করি।
সাউথ এশিয়ান গেমসের আগেও ঘটেছিল এক দুর্ঘটনা। ফেডারেশনের সবাই আশা নিয়ে বসেছিল, আমি স্বর্ণপদক পাব। এদিকে আগের দিন অনুশীলনের সময় ব্যথা পেলাম। দলের ডাক্তার বলেছিলেন, এই ব্যথা নিয়ে খেলা ঠিক হবে না। আগের দিন রাতেও খুব ব্যথা ছিল। হাত ভাঁজ করতে পারছিলাম না। পরদিন খেলেছি ঠিকই। স্বর্ণপদকও পেয়েছি। আসলে একেকটা বাধাই মনে হয় আমাকে আরও জেদি করে দিয়েছিল।
আমি অনুপ্রেরণা পাই মাশরাফি বিন মুর্তজা ভাইয়ের কাছ থেকে। তাঁর দুই পায়ে কতবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি যে পরিমাণ ব্যথা নিয়ে খেলেন, তাঁর কাছে আমার ব্যথা তো কিছুই না। শুনেছি প্রতিবার খেলার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তাঁকে পায়ের শুশ্রূষা করতে হয়। তাই যতই ব্যথা পাই না কেন, তাঁকে দেখে নিজেকে সাহস দিই।
এখন আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি ২০১৮ সালের কমনওয়েলথ গেমসের জন্য। সামনের বছর আবার নতুন মাবিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। প্রথমত, প্রতিযোগিতা আমার নিজের সঙ্গে, যেন নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারি। আর হ্যাঁ, আরও একটা স্বপ্ন তো আছেই। বাবা বলেছেন, ‘আমার একটা অলিম্পিকের মেডেল চাই।’ বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। বাবা, ফেডারেশন, দেশের মানুষ—সবার প্রত্যাশার চাপ অনেক। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার ভারও তো কম না। তাতে কী? ভার বহন? সেটাই তো আমার কাজ!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.