‘অনেক যত্ন করে ঈদের জন্য দুই সেট জামা বানিয়েছিল রিশা। সারপ্রাইজ দেবে বলে বন্ধুদেরও সেগুলো দেখতে দেয়নি। আগলে রেখেছিল আলমারিতে। এখন সে জামা কে পরবে? কে নতুন পোশাক পরে সালাম করবে? সালামি চাইবে? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল।’ গতকাল বিকালে সুরাইয়া আক্তার রিশার (১৫) নিথর দেহ আঁকড়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন তার মা তানিয়া হোসেন। মা যখন অঝোরে কাঁদছেন তখন মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশের পাশে নির্বাক বসেছিলেন বাবা রমজান আলী। প্রিয় সন্তান হারানোর শোক যেন পাথর করে দিয়েছে হতভাগ্য এ পিতাকে।
রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির বাংলা ভার্সনের ছাত্রী রিশা। স্বজনদের অভিযোগ, গত বুধবার কাকরাইলে স্কুলের কাছে ফুটওভারব্রিজে তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় বখাটে ওবায়েদুল। সে এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী লেডিস টেইলার্সের কাটিং মাস্টার। এরপর মুমূর্ষু অবস্থায় রিশাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিল সে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাকে বাঁচানোর। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গতকাল রোববার সকালে মারা যায় রিশা। স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও এখন পর্যন্ত পুলিশ ওবায়েদুলকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তারা আরও জানান, ঘাতকের শেষ অবস্থান ছিল দিনাজপুরে।
এদিকে রিশা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রুবেল নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে। রমনা থানা পুলিশ সূত্র জানায়, ওবায়েদুলের সঙ্গে রুবেলের যোগাযোগ ছিল। দুদিন আগেও সে ফোন করে রুবেলকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মার্কেটের (ইস্টার্ন মল্লিকা) কী অবস্থা? মার্কেটে তার বিষয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে কিনা? সূত্র আরও জানায়, রুবেল ছাড়াও বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রিশার মৃত্যুসংবাদে গতকাল শোকের ছায়া নেমে আসে তার প্রিয় বিদ্যাপীঠেও। তার খুনিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল কাকরাইল মোড়ে স্কুলের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। বেলা ১১টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। কর্মসূচি থেকে পুলিশকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্ত ওবায়েদুলকে গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন তারা।
রিশার বাবা রমজান আলী বলেন, ওবায়েদুলই আমার মেয়েকে ছুরিকাঘাত করেছে। ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকাকালে রিশাই তার মাকে এ কথা জানায়। বিষয়টি পুলিশকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা এখনো হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আন্তরিকতার সঙ্গে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে তা সম্ভব হতো। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাহলে কি অন্যান্য ঘটনার মতো আমার মেয়ের হত্যার ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যাবে? এ সময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি, ভেঙে পড়েন বাঁধভাঙা কান্নায়। রিশার ছোট ভাই সুমন জানায়, দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে রিশা ছিল সবার বড়। বড় হলেও আমরা বন্ধুর মতোই চলতাম। রিশা নেই, এটা ভাবতেই পারছি না। আমরা তার হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। রিশার বড় মামা মুন্না বলেন, ঘটনার পর পুলিশ বৈশাখী টেইলার্সের মালিককে ধরে ছেড়ে দিল। কিন্তু ওবায়েদুলকে গ্রেপ্তারই করতে পারল না। তাদের খুঁটির জোর কোথায়, সেটা আপনারা বের করুন প্লিজ। তিনি আরও বলেন, ওবায়েদুল খুবই প্রযুক্তিবান্ধব বলে মনে হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছি, সে এখন দিনাজপুরে আছে। কিছুক্ষণের জন্য তার ফোনটি খোলা হয়েছিল। সে সময়ই মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে তার অবস্থান জানা গেছে। আমরা এখন আশঙ্কায় আছি, সে না আবার সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যায়। এ জন্য সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি। রিশার হত্যাকারী যেন কোনোভাবেই দেশ ত্যাগ করতে না পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জানান, অভিযুক্তকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সে সর্বশেষ দিনাজপুরে অবস্থান করছে বলে তথ্য রয়েছে। তার ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছিল না, এমনকি যেখানে কাজ করত, সেখানেও ঠিকানা ছিল না। বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে ধরার চেষ্টা চলছে।
রমনা থানার ওসি মশিউর রহমান জানান, রিশার হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। তার মায়ের করা হত্যাচেষ্টার মামলাটি এখন হত্যামামলা হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সম্ভাব্য সব জায়গায় অভিযান চলছে।
জানা গেছে, বৈশাখী টেইলার্সের কাটিং মাস্টার হিসেবে প্রায় এক বছর কাজ করে ওবায়েদুল। সর্বশেষ গত রমজানের সময় রিশার মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার মা-বাবা বেঁচে নেই, গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার বীরগঞ্জ এলাকায়। এলিফ্যান্ট রোডের ঘরোয়া হোটেল ভবনের পাঁচতলায় একটি মেসে থাকত সে। তবে ওই মেসের কয়েকজন জানান, ৪-৫ মাস আগে ওবায়েদুল মেস ছেড়ে দেয়। সূত্র জানায়, রিশাকে ছুরিকাঘাত করার পর থেকেই সে পলাতক। এলিফ্যান্ট রোডের যে বাসায় সে থাকত সেখানেও পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। তাকে ধরতে পুলিশ প্রযুক্তিগত সহায়তা নিতে পারে, তাই গ্রেপ্তার এড়াতে ওবায়েদুল নিজের মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি বন্ধ রেখেছে।
এদিকে বৈশাখী টেইলার্সের মালিক মো. জাকির হোসেন জানান, ওবায়েদুল কাজে অনিয়মিত ছিল। ঠিকমতো করত না। তার কারণে অর্ডার ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে রিশার মা ওবায়েদুলের বিরুদ্ধে বিচার দিলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ওই টেইলার্সের পাশের আরেক দোকানদার রুস্তম আলী জানান, জাকির হোসেনের দোকানে কাজ করা আগে তার দোকানেও ৭-৮ মাস কাজ করেছিল ওবায়েদুল। সে ঠিকমতো কাজ করত না। মাঝেমধ্যে কাজ ফেলে মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার কারণে তিনিও তাকে বিদায় করে দেন।
এদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার পর রিশার মৃত্যুসংবাদ তার স্কুলে পৌঁছলে কান্নায় ভেঙে পড়ে সহপাঠীরা। প্রিয় বন্ধুর হত্যার বিচার দাবিতে নেমে আসে রাস্তায়। তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। এ সময় স্কুলের সামনে ব্যস্ততম সড়ক আটকে প্রতিবাদ জানাতে থাকে তারা। সেøাগান দিতে থাকেÑ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর রিশা’। শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদী কর্মসূচিতে ছিল রিশার প্রিয় বান্ধবী উমাইয়াও। তার হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘রিশা হত্যার বিচার চাই।’ অনেক প্রশ্ন করা হলেও সে শুধু একটি কথাই বলছিল, ‘বিচার চাই, বিচার চাই।’ রিশার আরেক সহপাঠী ফারিয়া বলে, সবসময় হাসিখুশি থাকত রিশা। সবার সঙ্গে মিশত। সে খুবই চঞ্চল ছিল। স্যাররা কখনো তাকে শাসন করলেও হাসত। ওকে আর কোনো দিন ফিরে পাব না। বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ফারিয়া।
রিশার স্কুলে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক রেহানা আক্তার শিল্পী অভিযোগের সুরে বলেন, রিশার আজ এই অবস্থার জন্য বর্তমান প্রিন্সিপাল অনেকটা দায়ী। আগের প্রিন্সিপাল সেনাবাহিনীর লোক ছিলেন। তিনি নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রিন্সিপাল নিজের নিরাপত্তার কথাই বেশি ভাবেন। নিরাপত্তার সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এমনটা হতো না। তবে স্কুলটির অধ্যক্ষ আবুল হোসেন জানান, অভিভাবকদের অভিযোগ সঠিক নয়। আমাদের স্কুলের সামনে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার রয়েছে। কিন্তু যেখানে রিশাকে মারা হয়েছে সেটা স্কুলের বাইরে। রিশা মারা যাওয়ায় সবার মতো আমরাও ব্যথিত। তার হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের জন্য পুলিশকে সর্বাত্মক সহায়তা করছি।
স্কুলটির অভিভাবক ফোরামের সভাপতি আঞ্জুমান আরা বলেন, আমাদের মেয়েরা আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কেন রিশা আজ মারা গেলÑ আমরা এর জবাব চাই। আমাদের মেয়েরা এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। আমরা আমাদের সন্তানের নিরাপত্তা চাই।
রিশার স্কুলের গণিত বিভাগের শিক্ষক ইকবাল হোসেন জানান, সবার অনেক আদরের ছিল রিশা। হাসিখুশি থাকত সবসময়। ছিল মেধাবী। কিন্তু এ সমাজ তাকে বাঁচতে দিল না। আমরা এর বিচার দাবি করছি।
জানা গেছে, বাবা, মা ও দুই ভাই-বোনের সঙ্গে বংশাল থানার সিদ্দিকবাজার এলাকার ১০৪ নম্বর বাসায় থাকত রিশা। প্রায় ছয় মাস আগে মায়ের সঙ্গে বৈশাখী টেইলার্সে যায় সে। সেখানে একটি ড্রেস সেলাই করতে দেয়। পরে দোকানের রিসিটে বাসার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেয়। পরে সেই রিসিট থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে কাটিং মাস্টার ওবায়েদুল খান ফোনে উত্ত্যক্ত করত রিশাকে। পরে সিমটি বন্ধ করে দিলে ওই বখাটে স্কুলে যাওয়ার পথেও তাকে উত্ত্যক্ত করত। প্রেমের আহ্বানে সাড়া না পেয়ে বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে স্কুলের সামনে ফুটওভার ব্রিজে রিশার পেটের বাম পাশে ও বাম হাতে ছুরিকাঘাত করে ঘাতক ওবায়েদুল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাফি জানান, দুপুরে স্কুলের সামনের ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে কলেজে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় চিৎকার শুনে ফুটওভার ব্রিজের ওপর গিয়ে রিশাকে আহতাবস্থায় দেখতে পান। এ সময় একজনকে দৌড়ে পালাতে দেখেন রাফি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রিশাকে প্রথমে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় ঢামেক হাসপাতালে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.