সারা দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে কম-বেশি ২ হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং আছে। এর মধ্যে ২ হাজার ১৭০টিতে, অর্থাৎ ৮৫ শতাংশে কোনো গেট নেই। নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও। নেই সংকেত বাতি। রেলওয়ে সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। গত রোববার গাজীপুরে এমনই একটা অরক্ষিত রেলক্রসিং গাড়িতে পার হতে গিয়ে দুই শিশুসহ এক পরিবারের পাঁচজনের প্রাণ গেছে। রেলওয়ের ও রেলওয়ে পুলিশের দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অরক্ষিত ও সুরক্ষিত—সব ধরনের রেলক্রসিংয়ে পথচারীরা সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির শিকার হচ্ছে। রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে গাড়ি চাপা পড়া ও ধাক্কা খেয়ে ছিটকে প্রাণহানির ঘটনাও নিত্যদিনের। রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের (নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল) হিসাবে দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৫০ জন মানুষ রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের সবাই পথচারী। আর রেলের হিসাবে, রেলক্রসিংয়ে বছরে গড়ে ২০টি ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আর এসব সংঘর্ষে বছরে প্রাণ যায় গড়ে ৩০ জনের। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন রেলক্রসিংয়ে যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, রেলপথের ধারণার সঙ্গে তা বেমানান। ভবিষ্যতে রেলপথের পাশে মানুষ বাড়বে। রেলক্রসিং বাড়বে। ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে। এমনকি ঘন ঘন দুই দিক থেকেই ট্রেন চলবে। ফলে সামনে আরও বিপদ। তাই রেলপথ ও সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তার জন্যও বিনিয়োগ করতে হবে। এর সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলে সামছুল হক বলেন, প্রথমত রেলপথ সারা বিশ্বেই অগ্রাধিকার পায়। এ জন্য রেলক্রসিং আস্তে আস্তে তুলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে সড়ক ওপর দিয়ে বা নিচে দিয়ে নিতে হবে। যে পর্যন্ত রেলক্রসিং তোলা সম্ভব হবে না, তত দিন গেট ও কর্মী দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রেলপথ, স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিলে রেলপথের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর মনে রাখতে হবে, মানুষকে পথ পারাপারে সচেতন হতে হবে। মানুষ সচেতন না হলে যানবাহন ও রেলের গতি বাড়ানো সম্ভব নয়। দুর্ঘটনা এড়াতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তাদের গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিংগুলোতে উড়ালসেতু নির্মাণ করছে। কিন্তু অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগ সড়ক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও ইউনিয়ন পরিষদের। কিন্তু এই দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় উদ্যোগ নেই। আর রেলের অনুমোদিত ক্রসিংয়েরও একটা বড় অংশ অরক্ষিত। রেলওয়ে সূত্র জানায়, অনুমোদিত অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে গেট দেওয়া ও কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে ৯৭ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প নিয়েছে রেলওয়ে। আগামী জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের গড় অগ্রগতি সাড়ে ১২ শতাংশ। এই দুটি প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ৬৭২টি রেলক্রসিংয়ে গেট স্থাপনের কথা রয়েছে। প্রায় দুই হাজার কর্মী নিয়োগের কথা এসব গেটে দায়িত্ব পালনের জন্য। রেল কর্তৃপক্ষ ক্রসিংয়ের উন্নয়নে প্রকল্প নেয় ২০০৯ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদন পেতে সময় লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। রেলওয়ে ও পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খুব আগ্রহী হয়নি। অবশেষে গত বছর এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। অবশ্য রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, গেট আর কর্মী নিয়োগ করার পরও ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে পথচারীদের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পারাপার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি পথচারীদেরও দায়িত্ব রয়েছে দেখেশুনে পথচলা। অরক্ষিত রেলক্রসিং রেলওয়ে সূত্র বলছে, এই অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অরক্ষিত এসব রেলক্রসিংয়ে মানুষের প্রাণহানি নিয়ে রেলের কোনো দায় নেই। যানবাহন চলাচলের কারণে যাতে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য বাড়তি একটি রেলের পাত দিয়ে রেললাইন সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আর যানবাহন ও মানুষ পারাপারের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ একটি সতর্কবাণী-সংবলিত সাইনবোর্ড দিয়েই দায় সেরেছে। রেলের অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে যেসব সাইনবোর্ড রয়েছে, এর অনেকগুলোর বার্তা এমন, ‘এই গেটে কোনো গেটম্যান নাই, পথচারী ও সকল প্রকার যানবাহনের চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার করিবেন এবং যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকিবেন।’ আবার এমন সাবধানবার্তাও দেখা যায়, ‘এই স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।’ রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেলের আইন অনুসারে লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যেকোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটকের মাধ্যমে বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে জমার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু মানুষের চাহিদা ও নিরাপত্তার বিষয়টি তো আর অস্বীকার করা যায় না। ফলে রেল ও সরকারের অন্য বিভাগগুলোর মিলেমিশে একটা সমাধানে আসা উচিত। বৈধ-অবৈধর বিতর্কে নিরাপত্তাঝুঁকি রেলপথে যেসব ক্রসিং রয়েছে, সেগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এগুলো হচ্ছে অনুমোদিত ও অননুমোদিত। রেলের হিসাবে, সারা দেশে ১ হাজার ৪১৩টি ক্রসিং রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত। বাকি ১ হাজার ১২৮টি ক্রসিং রেলের অনুমোদন ছাড়াই করা হয়েছে। অননুমোদিত রেলক্রসিংয়ের ৮৭ শতাংশই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও ইউনিয়ন পরিষদের তৈরি করা রাস্তার ওপর। বাকিগুলো পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা সড়কের ওপর। অনুমোদনহীন রেলক্রসিং কার দায়িত্বে থাকবে—এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে টানাহেঁচড়া চলছে। রেলের রীতি অনুসারে, রেললাইনের ওপর দিয়ে কোনো সড়ক নির্মাণ হলে গেট ও কর্মী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা তৈরির দায়িত্ব ওই সংস্থার। প্রথমে সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান গেট তৈরির আগ্রহ দেখিয়ে রেলে প্রস্তাব পেশ করে। পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গেট ও অবকাঠামো তৈরি এবং কর্মী নিয়োগের পর ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসাব করে তা সড়ক নির্মাণকারী সংস্থাকে দেয়। চাহিদামতো অর্থ পেলেই রেলক্রসিংয়ে গেটসহ কর্মী নিয়োগ দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। তবে রেলওয়ে সূত্র জানায়, অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের ৭৪ শতাংশেও কোনো গেট বা কর্মী নেই। এসব ক্রসিংয়ে মানুষকে নিজ দায়িত্বে রেল পারাপারের নির্দেশনা দিয়েই দায় সেরেছে রেলওয়ে। জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফিরোজ সালাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদিত রেলক্রসিংগুলোতে কর্মী দেওয়ার জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার লোক নিয়োগ হয়ে যাবে। আর কিছু কিছু ক্রসিংয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অননুমোদিত রেলক্রসিং নিয়ে তাঁদের করার তেমন কিছু নেই। বিভিন্ন জেলার প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে এসব রেলক্রসিং বন্ধ কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কাজ হয়নি। আবারও একই চিঠি দেওয়া হবে।