১৯২২ সালের ১৫ই জানুয়ারি। এখন জেলা হলেও সুনামগঞ্জ তখন ছিল সিলেট জেলারই একটি মহকুমা। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তখন সুনামগঞ্জই যেনো অনেক দূরের পথ। সেই সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের (বর্তমানে উপজেলা) প্রত্যন্ত এক গ্রাম ভুরাখালি। তখন কে জানতো সেই তারিখটিকে গায়ে জড়িয়ে প্রত্যন্ত এ গ্রামটি ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। সে দিন কান্নার মাধ্যমে ভুরাখালি গ্রামে জন্ম হয়েছিলো যার সে ক্ষণজন্মা মানুষটিই পরে বাংলাদেশের অনেক হাসি-কান্নার সাক্ষী হয়েছেন। আবদুস সামাদ আজাদ। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে দাপিয়েছিলেন রাজনীতির মূলমঞ্চ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক মহীরুহ হয়ে উঠেন তিনি। আজ তার ৯৫তম জন্মদিন। কাছে না থেকেও তিনি এখনো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। পুরো ভারতবর্ষ যখন এক দেশ তখনই রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেছিলো আবদুস সামাদ আজাদের। ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হন তিনি। পরে অবিভক্ত আসামের সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৪৮ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে বিএ পাসের পর আইন নিয়ে পড়তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হলে আবদুস সামাদ আজাদ যুক্ত হন মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে। ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করায় বিপাকে পড়েন ছাত্রনেতা আবদুস সামাদ আজাদ। এমনকি এ ‘অপরাধে’ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কিছুদিন অন্য দুটো পরিচয় নিজের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। তার ‘মাস্টার সাব’ পরিচয়টি অনেকেরই অজানা। অজানা রয়েছে তার বীমা নির্বাহী পরিচয়টিও। অজানা থাকারই কথা, রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে যে পরিচয় তিনি অর্জন করেছেন তার সামনে আর কোনো পরিচয় টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ। তখন চলছে ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে আবদুস সামাদ আজাদকে কারাবরণও করতে হয়। রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে ১৯৫৩ সালে যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান আবদুস সামাদ আজাদ। পরের বছর যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে সুনামগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ অধ্যায়ের ইতি ঘটিয়ে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ। আদর্শগত কারণে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরলে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আবদুস সামাদ আজাদ কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে আটক হন তিনি। মুক্তি পান চার বছর জেল খাটার পর। ১৯৬৪ সালে আবারো গ্রেপ্তার হন তিনি। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়ে ১৯৬৯ সালে আবদুস সামাদ আজাদ ফিরে আসেন নিজের ঘর আওয়ামী লীগে। নির্বাচিত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। আন্দোলনের পথ বেয়ে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন আবদুস সামাদ আজাদ। প্রথমে তিনি মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত। দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আবদুস সামাদ আজাদ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে দুটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পটপরিবর্তন হলে ষড়যন্ত্রীদের হাতে গ্রেপ্তার হন আবদুস সামাদ আজাদ। ভাগ্য ভালো থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন নইলে ৩রা নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে ৪ জনকে নয় স্মরণ করতে হতো জাতীয় ৫ নেতাকে। প্রাণে বেঁচে গেলেও ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারার অন্ধকারেই থাকতে হয় আবদুস সামাদ আজাদকে। মুক্তির পর পঁচাত্তরের ধাক্কায় টালমাটাল আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবদুস সামাদ আজাদ। নিপীড়ন-নির্যাতনেও রাজনীতির মাঠ কখনোই ছেড়ে যাননি আবদুস সামাদ আজাদ। ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও মাঠে ছিলেন শুরু থেকেই। এরশাদ সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তিতে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবার তিনি পান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব। সাফল্যের সঙ্গে তিনি তার সে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের পরবর্তী নির্বাচনেও তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায়ই ২০০৫ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের রাজনীতির বটবৃক্ষ আবদুস সামাদ আজাদ। জীবদ্দশায় তো নয়ই মৃত্যুর পরও সামাদ আজাদের জন্মদিনে সিলেটে কোনো আয়োজন হয়নি। এবার সে বন্ধ্যত্ব ঘুচাতে যাচ্ছেন সিলেটের সাংবাদিকরা। সামাদ আজাদের স্মৃতি বিনিময় করতে আজ সন্ধ্যায় সামাদ আজাদের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে বসবেন তারা। থাকবেন সামাদ আজাদের ছেলে আজিজুস সামাদ ডনও।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.