সারা বিশ্বেই টেলিভিশন একটি অন্যতম বিনোদন মাধ্যম। মানুষের বিনোদনের খোরাক মেটানোর জন্য এ মাধ্যমটি কালে কালে নানাভাবে কাজ করে আসছে। বিশেষত প্রচারমাধ্যমের উন্নয়নে আবিষ্কার হয়েছিল টেলিভিশন যন্ত্রটি। এরপর এতে যুক্ত হয়েছিল বিনোদনের নানা আয়োজন। এক সময় মঞ্চ থেকে নাটকও উঠে এসেছিল টেলিভিশনের পর্দায়। কয়েক দশকের পালাবদলে টেলিভিশনের জন্যই নির্মিত হতে লাগলো নাটক। এখন এটি রীতি। আশি ও নব্বই এর দশককে নাটকের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ে ধারাবাহিকভাবে অনেক নাটক দর্শকপ্রিয়তা পায়। ভালো গল্প, দক্ষ নির্মাণশৈলি, সঠিক শিল্পী নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে মানসম্পন্ন নাটকগুলো দর্শকদের হৃদয়ে ঠাই করে নেয়। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে সে অবস্থা একেবারেই নেই। প্রযুক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে বাংলা নাটকের দর্শকও। বিশেষ করে গত দুই বছরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। অন্যদিকে বিজ্ঞাপনের আধিক্যের কারণে দীর্ঘসময় ধরেই দেশিয় নাটকমুখী হচ্ছেন না দর্শক। এর মধ্যে অনেক দর্শক অতি বিজ্ঞাপনে বিরক্ত হয়ে বেছে নিয়েছেন ভারতীয় চ্যানেলের নাটককে। আবার যারা বাংলা নাটকের খাঁটি দর্শক তারা দেখছেন বাংলা নাটকই, তবে টেলিভিশনে নয় ইউটিউবে। কারণ গত দুই বছরে ইউটিউব মাধ্যমটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে আমাদের দেশে। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখন ইউটিউব ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে দর্শকদের তরফ থেকে অভিযোগও রয়েছে। অনেক দর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাটক প্রচার সময়ে লাগামহীন বিজ্ঞাপন প্রচার, নাটকের মাঝে হঠাৎ সংবাদ প্রচার সহ নানা অসংগতির কারণে টিভি মাধ্যমের দর্শক বেছে নিয়েছেন ইউটিউবকে। যেখানে নেই কোনো বিজ্ঞাপন নামক কোনো যন্ত্রণা। যখন ইচ্ছে নিজের ইচ্ছেমতো দেখা যাচ্ছে নাটক। ইউটিউবে নাটক দেখার ফলে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম টেলিভিশন আজ হুমকির মুখেই বলা চলে। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনরা কি বলেন? জানতে চাইলে নাট্যব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হক বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই বা না চাই এটা চলবেই। ইউটিউবে নাটক দেখা আমাদের জন্য হয়তো ইতিবাচক। কারণ দর্শক অন্তত নাটকটা দেখছেন। কিন্তু আরেকটা দিক ভাবলে বলবো যে, আমরা যদি ইউটিউবে নাটক দেখি সেটার আসল স্বাদ পাই না। কারণ টিভিতে নাটক দেখার যে মজা সেটা ইউটিউবে দেখে পাওয়া যায় না। এখন বলা যায় দর্শক কেন ইউটিউবে নাটক দেখবেন। কারণটা খুব সহজেই বলতে পারি। চ্যানেলে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার। আর এর ফলেই বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ইউটিউবকে দর্শক বেছে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা ও নির্মাতা আবুল হায়াত বলেন, দর্শক এখন বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনাসহ নানা কারণে টিভি সেটের সামনে থেকে সরে গিয়ে ইউটিউবে টিভি অনুষ্ঠান দেখছে। তারা বিরতিহীনভাবে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছে। একজন শিল্পী হিসেবে আমি বলবো এটি ভালো হচ্ছে। কারণ আমাদের কাজগুলো তো অন্তত দর্শক দেখছে। কেউ যদি আমাদের কাজ দেখতে না পায় তাহলে এর মূল্য কি? প্রফেশন হিসেবে বলবো এটি ক্ষতির কারণ। অর্থাৎ টিভি যদি দর্শক হারায় তাহলে চ্যানেল আর আমরা সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এ কারণে টিভি চ্যানেলের উচিত এ অবস্থার উত্তরণে জরুরিভাবে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও নির্মাতা রোকেয়া প্রাচী বলেন, ইউটিউবে নাটক বেশি দেখলে ক্ষতি টিভি স্টেশনের, ক্ষতি আমাদের। সময়ের সঙ্গে বিষয়টি বড় একটা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মেনেও নিতে হবে। তবে আমরা যদি টিভি স্টেশনকে দর্শকের মন, রুচির সঙ্গে মেলাতে পারি, দর্শকের সময়কে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারি তখন তারা টিভিতে নাটক দেখবেন। আমরা টিভি আর সমপ্রচারের সময়কে সঠিকভাবে সাজাতে পারছি না। ইউটিউবে নাটক দেখতে দেখতে একসময় টিভি থেকে দূরে সরে যাবেন দর্শক। তাই দর্শকের ইউটিউবে নাটক দেখা আমাদের পেশার বর্তমান সমস্যার সঙ্গে আরেকটি প্রাসঙ্গিক সমস্যা। অভিনেতা আল মামুন বলেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য বাণিজ্যিক ভাবে ক্ষতির কারণ হলেও ইউটিউবের কল্যাণে কিন্তু আমরা নাটক দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি। তারা ভালো নাটক হলে অবশ্যই ইউটিউবে দেখছেন। এটাতো একটা পজিটিভ দিক। তবে একজন শিল্পী হিসেবে দর্শক চ্যানেলেই যেন নাটক দেখেন সে প্রত্যাশা তো থাকা উচিত। তবে চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তার মানে এই নয়, বিজ্ঞাপন পুরোদমে বন্ধ করার কথা বলছি। নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আর সে সঙ্গে সুষ্ঠু নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে সংকট কাটিয়ে উঠা যাবে। নির্মাতা অঞ্জন আইচ বলেন, যেভাবেই দেখছেন- দেখছেন তো। নাটক দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারছে এটাই আমাদের জন্য বড় কথা। তবে এই একই কারণে আমি নিজেও টিভি দেখি না। তাহলো অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা। এখান থেকে মুক্তি মিললে হয়তো দর্শককে আবারো টিভিপর্দায় ফেরানো যাবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.