পাংখোয়া পল্লী ২৫টি পাংখোয়া বসতি নিয়ে আকাশ ছুঁয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাথলিক আর ব্যাপ্টিস্ট- দুটি গির্জা আছে পাড়ার শুরু আর শেষ প্রান্তে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দণ্ডায়মান দোতলা মাচাং ঘরগুলো, সহসাই যেন এখানে ধরা দেয় মেঘের দল। যতক্ষণ পাড়ায় ছিলাম পুরো সময় মেঘ-বৃষ্টি-বাতাসের অবগাহন। পাংখোয়া পল্লীর চারপাশে তেঁতুল, বটবৃক্ষ, নারকেল গাছের প্রাকৃতিক বেষ্টনী। ধবধবে জ্যোৎস্নায় এমন একটি পাড়ায় রাতযাপনটা স্বপ্নের মতোই আনন্দের। কুকিমনের পথে রওনা হয়েছি তখন।
আষাঢের প্রায় শেষ পর্ব। পাহাড়ে প্রতিদিনই নিয়মিত বৃষ্টি। বৃষ্টি উপেক্ষা করে লংগদু পৌঁছেই শুভলংয়ের লঞ্চ পেলাম। ভরা বর্ষায় কাপ্তাই লেককে সমুদ্র বলাই শ্রেয়, বিস্তৃত জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাহাড়ে পাদদেশে। কাপ্তাই লেকে চলাচলকারী কাঠের দোতলা লঞ্চগুলো বৃষ্টি উপভোগের জন্য বেশ, লঞ্চের পেছনের ছাদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখাটা মায়াবী এক স্বপ্নের মতো। ঘন বৃষ্টির মধ্যে লঞ্চ যখন শুভলং বাজারে পৌঁছায়, তখন প্রায় মধ্য দিবস। এরপর শুভলং বাজারে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি। মূলত শুভলং বাজার রাঙামাটির প্রধানতম নৌরুট। জেলার বেশির ভাগ উপজেলায় যাতায়াত এই শুভলং বাজার হয়ে। তবে এবারে আমাদের যাত্রাপথ জুরাছড়ির কুকিমন পাহাড়ের পাংখোয়া পল্লী। জুরাছড়ি স্থানীয় এক আদিবাসী বন্ধুর মুখে প্রথম এই পাড়ার নাম শুনলাম। সেই পথেই এবার যাত্রা।
শুভলং বাজারে দুপুরের আহার সেরে, বিকেল ৩টার লঞ্চে রওনা হলাম জুরাছড়ির পথে। জলের স্রোতের কেটে কেটে লঞ্চ চলেছে সবুজে ঘেরা জলাভূমির পথ ধরে, কাপ্তাই লেকের একটা অংশ জুরাছড়িতে এসে শেষ হয়ে গেছে। জুরাছড়ির স্রোতধারায় ঘন শ্যাওলা আর নীল পানি। লেকের পাড়ে পাহাড়ের ডানায় বসবাস করা পাহাড়ের আদিবাসীদের বসতি আর জুম ফসলের আবাদ। বিকেলের রঙিন আকাশের ছায়া পড়েছে গেরুয়া পাহাড়ের গায়ে, নিঃশব্দের জলাভূমি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে জুরাছড়ির কুকিমন পাহাড়ের চূড়াগুলো ঢেকে গেছে সাদা মেঘের আচ্ছাদনে। নীল জলের নিচে সবুজের বাগান অনেকটা আন্ডার ওয়াটার গার্ডেনের মতো। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা ছোট্ট কুটিরগুলোও ঘন মেঘের চাদরে ঢাকা। মেঘের কারণে সবুজ বর্ণগুলো মুহূর্তে সাদা হয়ে যাচ্ছিল। বিকেল নাগাদ জুরাছড়ির ঘাটে পৌঁছালাম। জুরাছড়ি থেকে দেশি বোটে রওনা হলাম, যাত্রা হলো বনযোগীছড়া বাজারের পথে। জুরাছড়ি থেকে কিছুটা গেলেই বনযোগীছড়া বাজার, তবে চারপাশে জল আবৃত হওয়ায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একমাত্র ভরসা। দেশি বোটে বনযোগীছড়া পৌঁছে যায়। বনযোগীছড়া বাজার থেকে কিছুটা মোটরবাইকে যাওয়ার পর বাকি পথ ঝিরির, পাথুরে ঝিরিতে পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানির স্রোত। সবুজে ঢাকা বুনো ট্রেইল! ঝিরির পথ বয়ে নেমে গেছে কুকিমন পাদদেশ ঘেঁষে, ঝিরিপথে জলের বাঁক পেরিয়ে কুকিমন পথে পা ফেললাম। কুকিমনের পাংখোয়া পল্লীতে যাওয়ার একমাত্র পথে হাঁটা শুরু হলো, পুরোটায় খাড়া পথ, পাহাড়ে উঠতে মেঘের দল এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, পথের দুই পাশের ঘন বন, কোথাও কোনো বসতি চোখে পড়ছে না। মেঘ-বৃষ্টি-রৌদ্দুর পেরিয়ে যখন পাংখোয়া পল্লীতে পৌঁছাই তখন প্রায় দিনের শেষভাগ। পাড়ার সীমানায় ঢুকতেই লাল-সবুজের পতাকা স্বাগত জানাল, সমতল ভূমি থেকে এত ওপরে এই বুনো পরিবেশে ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় দেশের পতাকা। পাংখোয়া ছেলেমেয়েরা এই স্কুলের শিক্ষার্থী, ৪৫ জন পাংখোয়া ছাত্রছাত্রী এই স্কুলে। পাড়াটিতে শুধু পাংখোয়া আদিবাসীদের বসবাস। যেন ছবির মতো সুন্দর পাড়াটি-পাংখোয়াদের স্বর্গপল্লী।
কুকিমন পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ৬১০ ফুট ওপরে। পাহাড়ের ওপর থেকে যতটুকু চোখ যায় কেবল সুনীল পাহাড়ের বন্ধনী, নিচের পৃথিবীটা জলের দখলে। সুনীল আকাশ আর সাদা জলের দেশে সুউচ্চ পাহাড়ে সুদীর্ঘ কালের বসতি।
যেভাবে যাবেন
জুরাছড়ির পাংখোয়া পল্লী যেতে হলে প্রথমে ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে বাসযোগে যেতে হবে রাঙামাটি পর্যন্ত, শ্যামলী, হানিফ, এস আলমসহ বিভিন্ন পরিবহন প্রতিদিন রাঙামাটিতে যাতায়াত করে। তা ছাড়া চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকে পাহাড়িকা বা বিআরটিসি পরিবহনে রাঙামাটি পৌঁছানো যায়। রাঙামাটি থেকে লঞ্চে করে যেতে হবে জুরাছড়ি পর্যন্ত, জুরাছড়ি থেকে দেশি বোটে বনযোগীছড়া, বাকি পথটা হেঁটে কুকিমন পাহাড়ের পাংখোয়া পল্লীতে পৌঁছানো যায়।
প্রয়োজনীয় তথ্য
কুকিমনে পাহাড় বাবা পাংখোয়া পল্লীতে রাতযাপনের কোনো সুযোগ নেই, রাতটা জুরাছড়িতে থাকতে হবে। পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয় করে এমন কোনো কর্মকাণ্ড করা যাবে না, আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কাপ্তাই লেকের গভীরতা অনেক সাঁতার না জানলে লেকের জলে নামবেন না। কোনো প্লাস্টিক বা অপচনশীল জিনিস পাহাড়ে ফেলে আসবেন না, সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
সূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.