রাকিবুল ইসলাম। চালাতো রিকশা। এক ভোরে যাত্রীসহ পড়ে ছিনতাইকারীর কবলে। ক্ষুরের আঘাতে সেও রক্তাক্ত হয়। এ ঘটনা বিষাক্ত করে দেয় তার জীবন। নিজেও বেছে নেয় সেই নিন্দিত পথ। নিষিদ্ধ পেশা। ছিনতাই করা এখন তার কাজ। ২০ বছর ধরে সে রাজধানীতে ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। এ দীর্ঘ সময়ে শত শত মানুষের সহায়সম্বল কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু মানুষের সুখ ও মুখে হাসি কেড়ে নিয়ে সে নিজেও সুখী হতে পারেনি। সুখের সন্ধানে সে এখনো অসুখী। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করে। তার স্ত্রীও ছিনতাই হয়ে যায়। কেড়ে নেয় অন্য ছিনতাইকারী। এখন তার অন্য সংসার। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু সুখ-শান্তি নেই। ছিনতাইয়ে মাসে রোজগার লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু মাদকের পেছনেই সব শেষ। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। অবিশ্বাস আর ধরিয়ে দেয়ার ভয় থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় বারবার স্থান পরিবর্তন করে সে। রাকিবুল জানায়, ১৯৮৮ সালের দিকে ঢাকায় আসে। তখন বয়সে কিশোর। উঠে কাকরাইল এলাকায়। চাকরি নেন একটি ডেকোরেশন প্রতিষ্ঠানে। তারপর বেইলি রোডে একটি ক্লাবে। সেখানে একটি বিল হারিয়ে ফেলায় তার পাওনা ৬ হাজার টাকা আর তাকে দেয়া হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কাজ ছেড়ে দেয়। এদিকে মা-বাবা এবং দুই ভাই এক বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসায় বিপাকে পড়ে। বাধ্য হয়ে রিকশা চালানোর কাজ নেয়। এরই মাঝে এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গাঁজা খাওয়া শুরু করে। একদিন শেষ রাতে মতিঝিল মোড়ে রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ব্রিফকেসসহ এক যাত্রী এসে বললো বাড্ডায় যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো রিকশাচালক রাজি হয়নি। ওই লোকের দুর্দশার কথা ভেবে সে রাজি হয়। তারপর রওনা। এক গলির মুখে যেতেই কয়েকজন ছিনতাইকারী রিকশা আটকায়। তার পিঠে ক্ষুরের পোচ দিয়ে থামতে বলে। ওই যাত্রীকেও কয়েকটি পোচ দিয়ে তার সবকিছু নিয়ে যায়। এরপর সে ক্ষুব্ধ হয়ে নেশা বাড়িয়ে দেয়। সেও ধীরে ধীরে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে। শুধু সে নয়, তার অপর ভাইও নামে একই পেশায়। সে অবশ্য এখন জেলে। রাকিবুলও কয়েক মাস আগে জেল থেকে ছাড়া পায়। রাকিব জানায়, ১৭ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। ২০ বছর ধরে থাকে শাহবাগ এলাকায়। অন্যদের সঙ্গে ছিনতাই করে। চলন্ত গাড়ি যাওয়ার সময় খোলা জানালার দিকে খেয়াল রাখে কেউ মোবাইলে কথা বলছে কিনা। দেখলে চুপিসারে এগিয়ে যায়। যাওয়ার আগে পালাবার রাস্তাটাও ঠিক করে নেয়। গাড়ির কাছে গিয়েই ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। একইভাবে ছিনিয়ে নেয় নারীদের কানের দুল, গলার হারও। কয়েকজন মিলেও করে ছিনতাইয়ের কাজ। দুজন যানজটে আটকে পড়া বা ধীরগতিতে চলা গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সুযোগ পেলেই পথচারী বা যাত্রীর ব্যাগ নিয়ে সটকে পড়ে। তা সম্ভব না হলে একজন কৌশলে ব্যাগের কৌশলে চেইন খুলে ফেলে। অন্যজন পরিস্থিতি বুঝে ব্যাগের ভেতরের টাকা ও মোবাইল নিয়ে সরে পড়ে। শুধু তাই নয়। অনেক সময় ঝুঁকি নিয়ে পিস্তল এবং ছুরি নিয়েও কাজ করতে হয়। তবে বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করতে হয় ক্ষুর ও ব্লেড। এছাড়া গাড়িতে চড়ে বড় বড় ছিনতাইয়েও যেতে হয় বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে। তার কথা, নিজেকে রক্ষার জন্য হিংস্র হতে হয়। ধরা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যকে আঘাত করতে হয়। ছুরি ব্যবহার করতে হয়। কয়েকদিন আগে আমাকে কয়েকজন মিলে মারধর করছিল। একপ্রকার অচেতন হয়ে পড়ি। পরে আমার মনে পড়ে পকেটে ব্লেড আছে। তখনই বুদ্ধি করি। সেই ব্লেডটি বের করে তাদের পোচ দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কারও গায়ে লাগেনি। পরে নিজেই নিজের মাথায় দু’তিনটা পোচ দিই। আমার মাথা দিয়ে সারা শরীরে রক্ত পড়ছে দেখে সবাই ভয় পেয়ে আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর সরে পড়ি। এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ কাজে আয় কেমন জানতে চাইলে বলে, মাসে ১ থেকে দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়। কিন্তু সে টাকার ভাগ দিতে হয় বস ও দালালদের। দালালরা ১টা ১০ হাজার টাকার মোবাইল কিনে মাত্র ১ হাজার টাকায়। আমরা কষ্ট করি, যেখানে সেখানে থাকি। আর লাভ করে দালালরা। কিছু পুলিশ সদস্যকেও টাকা দিতে হয়। আবার জেলে গেলে তারা অবশ্য জামিন করিয়ে নিয়ে আসে। এ পর্যন্ত ৬-৭ বার জেলে যেতে হয়েছে বলেও জানায় এই ছিনতাইকারী। ছিনতাইয়ের টাকার বিষয়ে বলে, ওই টাকা থাকে না। মাদকের পেছনে খরচ হয়ে যায়। কিন্তু কয়েকজন আবার ওই টাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছে। আমাদের সঙ্গে কাজ করা আল আমিন এখন ঢাকাজুড়ে ছিনতাই করে। সে রংপুরে জায়গা কিনে বিল্ডিং করেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.