উদ্ভাবনের কাজটি মেহযেব চৌধুরী করেছেন যুক্তরাজ্যে। তবে তাঁর বেলায় ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত’ কথাটি বলতে হচ্ছে না। পুরো গর্ব করে বলা যাচ্ছে, অপরাধ তদন্তে বৈপ্লবিক এক আবিষ্কার নিয়ে হাজির হয়েছেন বাংলাদেশের মেহযেব চৌধুরী। যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফরেনসিক সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন’ বিষয়ে পিএইচডি করছেন তিনি। এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন মেহযেব, যা দিয়ে বিচারক বা জুরিরা আদালতে বসেই অপরাধ সংঘটনের স্থান (ক্রাইম সিন) পরিদর্শন করতে পারবেন। তাঁর এই উদ্ভাবন ঘটনাস্থলের নির্ভুল পর্যবেক্ষণ এবং সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে বলেও মনে করা হচ্ছে। মেহযেবের এই উদ্ভাবনের কথা প্রকাশ হয় গত ২৬ আগস্ট। এরপরই বিশ্ব গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। আটলান্টিকের ওপারের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দুটি পুলিশ বিভাগ মেহযেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছে, তারা দ্রুত এই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে চায়। মেহযেব চৌধুরী বানিয়েছেন একটি রোবট। এটি ৩৬০ ডিগ্রি রেখায় অর্থাৎ ঘটনাস্থলের চারদিকের ভিডিওচিত্র ধারণ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে এর। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দেশিত পথে চলতে পারে। এটি ঘটনাস্থলের বাধা-বিপত্তি সম্পর্কে সচেতন থাকবে—যেমন কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাবে না। আবার গুরুত্বপূর্ণ আলামত যেমন রক্তের ওপর দিয়ে যাবে না।
এই রোবটের নাম মেহযেব দিয়েছেন ‘ম্যাবম্যাট’ (এমএবিএমএটি)। ম্যাবম্যাট যে ভিডিও ধারণ করে সেটিকে বলা হচ্ছে ‘ভার্চু৵য়াল রিয়েলিটি’ বা পর্দায় বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন। যা কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের পর্দায় ওপর-নিচ, ছোট-বড় কিংবা চারপাশে ঘুরিয়ে পুরো স্থানটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখাবে। ২৯ আগস্ট রাতে দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে মেহযেব প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁর উদ্ভাবন এবং এর পেছনের গল্প। শুরু করলেন এভাবে,—‘বিচারকেরা কোনো অপরাধের বিচার করতে গিয়ে যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেখানে সাধারণত যান না। ফরেনসিক অনুসন্ধান দলের তোলা ছবি, ভিডিও বা স্ক্র্যাচের ভিত্তিতে তাদের অপরাধ সংঘটনের স্থান সম্পর্কে ধারণা নিতে হয়। বর্তমানের প্যানোরমা কিংবা ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) প্রযুক্তিতে ভিডিও ধারণ করলেও পুরো স্থানের সমন্বিত অবয়ব পাওয়া সম্ভব নয়।’ এর কারণ হিসেবে মেহযেব বলেন, ভিডিও ধারণকারীর শরীরের কারণেও ৪০ থেকে ৬০ ডিগ্রি জায়গা সব সময় বাদ থেকে যায়। এ ছাড়া আলামত সংগ্রহকারীর পক্ষপাতিত্ব বা গাফিলতির কারণে সঠিক চিত্র উঠে না আসার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি খণ্ড খণ্ড ছবি বা ভিডিওতে পুরো স্থানটির প্রকৃত অবস্থা বিবেচনাও সম্ভব হয় না। ‘আবার অপরাধ সংঘটন এবং বিচার শুরু হওয়ার মধ্যে সময়ের যে তফাত, সে কারণে বিচারকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলেও জায়গারই প্রকৃত অবস্থা পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতেই আমার প্রচেষ্টা। শুরুতেই যদি ঘটনাস্থলের বাস্তব চিত্র ধারণ করে রাখা হয়, তবে সেটি হবে তদন্ত ও বিচারের জন্য একটি স্থায়ী দলিল।’
মেহযেব চৌধুরী ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং সংবাদপাঠক মাহবুবা চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। তাঁদের বাড়ি হবিগঞ্জে। মেহযেব যুক্তরাজ্য থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০১০ সালে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। কাজ করেছেন ব্যারিস্টার রফিক–উল হকের সঙ্গে। সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ–এ। ২০১২ সালে অপরাধ তদন্ত বিষয়ে পড়াশোনা করতে আবারও আসেন লন্ডন। ডারহাম ইউনিভার্সিটিতে অপরাধ তদন্ত বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সেখানেই তিনি পিএইচডি করছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড সোশ্যাল সায়েন্সের একজন গবেষক ও শিক্ষক। মেহযেবের তৈরি রোবটের নাম ম্যাবম্যাট। মা মাহবুবার নাম থেকে ‘এমএবি’ এবং বাবা মতিউরের নাম থেকে ‘এমএটি’ যোগ করেই তিনি রোবটের নাম দিয়েছেন ম্যাবম্যাট। বললেন, ‘মা-বাবাই তো আমাকে এই দুনিয়া দেখিয়েছেন। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ তা শিখিয়েছেন। আমার মা-বাবার মতো আমার ম্যাবম্যাটও অপরাধ তদন্তে সঠিকভাবে কাজ করবে বলে আশা করছি।’
রোবটের চিন্তা যেভাবে
একদিন ঘরে বসে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ছবি দ্য মার্সান দেখছিলেন। ছবিতে দেখানো হচ্ছিল নাসার পাঠানো রোবট মঙ্গল গ্রহ (মার্স) থেকে ছবি তুলে পাঠাচ্ছে। এটি দেখেই মেহযেব ভাবলেন, ঘটনাস্থল তদন্তের কাজেও তো এমন রোবট ব্যবহার সম্ভব। মেহযেব বলেন, ‘সাথে সাথে গুগলে খোঁজ নিয়ে দেখলাম এমন কিছুর অস্তিত্ব আছে কি না। দেখলাম নেই। তখন ভাবলাম, তাহলে আমিই এটি বানিয়ে ফেলি।’
যেই ভাবা সেই কাজ মাত্র এক মাসেই তিনি বানিয়ে ফেললেন সাড়া জাগানো এই প্রযুক্তি। মেহযেব জানান, নিজস্ব ভাবনা, পরিকল্পনা এবং চেষ্টা ও অর্থায়নে তিনি এই রোবট তৈরি করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও সহকর্মীদের কাছ থেকে নানাভাবে উৎসাহ ও পরামর্শ পেয়েছেন। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের ৪০টি পুলিশ বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১০টির বেশি পুলিশ বিভাগ অপরাধ সংঘটন স্থানের তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। মাত্র ৮ মেগা পিক্সেলের ১৭০ ডিগ্রির দ্বৈত লেন্সের (ডুয়েল লেন্স) দুটি ক্যামেরাকে সামনে-পেছনে লাগিয়ে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে তিনি ৩৬০ ডিগ্রি রেখায় ভিডিও ধারণের ব্যবস্থা করেছেন। ব্যবহার করেছেন ‘র্যাস্পব্যারি পাই’ নামের ছোট্ট কম্পিউটার এবং একটি মাইক্রোকন্ট্রোলার বোর্ড বা মাদারবোর্ড। এতে তিনটি সেন্সর রয়েছে। আর আছে প্রয়োজনীয় ধাতব কাঠামো। বিশেষ অ্যাপ কিংবা রিমোট কন্ট্রোলার দিয়ে ম্যানুয়ালি এবং নির্দেশিত পথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি চালানো যাবে। সবকিছুকে সমন্বয় করেছেন প্রোগ্রাম দিয়ে। সব মিলিয়ে এর খরচ হয়েছে ২৯৯ পাউন্ড বা প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। মেহযেব বলেন, ‘স্বল্প খরচের এই প্রযুক্তি বিশ্বের যেকোনো দেশের পুলিশ বাহিনীর জন্য উপযোগী
শুধু কাজে লাগানোর অপেক্ষা
ম্যাবম্যাট রোবটটি নিয়ে মেহযেবের লেখা নিবন্ধ ২৬ আগস্ট দ্য কনভারসেশন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। প্রথম দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস ও ওয়াশিংটন ডিসি পুলিশের পক্ষ থেকে ই-মেইলে জানানো হয়, তারা দ্রুতই এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করতে আগ্রহী। এ জন্য তাঁকে মাঠপর্যায়ে রোবটটি পরীক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাই আশা করা যায় ‘ম্যাবম্যাট’ মাঠে নামবে শিগগিরই।
ম্যাবম্যাট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মেহযেবের মাথায় আরও একটি ভাবনা ঢুকেছে। তা হচ্ছে, ক্রাইম সিন স্ক্র্যাচিংয়ের কাজটি এখনো হাতে করা হয়। যাতে এক বস্তু থেকে অন্য বস্তু কিংবা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দূরত্ব সঠিকভাবে নির্দেশ করা সম্ভব হয় না। তিনি ডিজিটাল উপায়ে কাজটি নিখুঁতভাবে করার প্রযুক্তি বানাতে চান। এ কাজে গুগলের সহযোগিতাও চেয়েছেন। গুগল ট্যাংগো ভিডিও ধারণের সময় দূরত্ব মাপতে পারে। একেই নিজের উদ্ভাবনের কাজে লাগাতে চান বাংলাদেশি এই গবেষক।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.