খবরের কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। একেবারে আমি যা যা করি বা করেছি, তার হুবহু বর্ণনা। জব ডেসক্রিপশনের সঙ্গে এক্সপেরিয়েন্সের এমন ভাইবোনের সম্পর্ক আগে দেখিনি। মুশকিল হলো কাজটা শিকাগো শহরে নয়। তাহলে লাভ কি? ভাবলাম দিই একটা ঠুকে। পরে দেখা যাবে। ইন্টারভিউয়ে ডাকলে ওদের পয়সায় কেন্টাকির বড় শহর লুইভিলটা দেখা হয়ে যাবে। উড়ে গিয়ে যথারীতি হাজিরা ও ইন্টারভিউ দেওয়া হলো। ভেটারান হিসেবে প্রশ্নের উত্তরগুলো আমার নামতার মতো মুখস্থ। ইন্টারভিউয়ের পর মাতব্বরেরা তাদের গাড়িতে করে একটা দামি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করাতে নিয়ে গেলেন।
ব্যস, চাকরিটা প্রায় ৯০% হয়ে গেল। কিন্তু ইন্টারভিউটা ফরমালাইজড করার জন্য যেতে হবে পেনসিলভানিয়া স্টেটের টুন্খানক (Tunkhannock) নামক একটা জায়গায়। বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি প্রক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বলের (Procter & Gamble অথবা P & G) কারখানায়। অর্থাৎ শিকাগো তো নয়ই, লুইভিলেও নয়। চাকরিটা করতে হবে ওই টুন্খানকেই। আবার ইন্টারভিউয়ের কথা শুনে বউ বলল, তুমি বললে, পরের পয়সায় লুইভিলটা ঢুঁ মেরে আসি। এখন আবার জয়েন করার মতলব আঁটছ নাকি? আমি আদর্শ স্বামী হওয়ার ভান করে বলি, আরে না, পাগল নাকি? তোমার রেসিডেন্সি চলছে না? বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে না? এসব ফেলে কোথায় যাব? কিন্তু গুলবাজ স্বামী সংঘের বিশ্বস্ত মেম্বার না আমি? না গিয়ে পারি? গাড়িতে যেতে যেতে বস মুখ খুললেন, জান, এই যে প্রক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বল, দে বিল্ড দেয়ার প্ল্যান্ট ইন দ্য মিডল অব নো হোয়্যার। পুরো পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট বসায়। তারপর সাবসিডাইজ্ড হাউজিং কমপ্লেক্স বানায় কর্মচারীদের থাকার জন্য। লোকের বসতি দেখে আস্তে আস্তে দোকানপত্র আসে। বাজার-মল বসে। টাকা জমা নেবার জন্য ব্যাংকগুলো শাখা খোলে। হাউস বিল্ডার্সরা আসে, রিয়েলটরদের অফিস বসে। ক্রমে ছোটখাটো হোটেলও। পরের দিন সকালে পি অ্যান্ড জির সিনিয়র ম্যানেজারদের ইন্টারভিউ বোর্ড আমাকে ভীষণভাবে পছন্দ করে বসল। বস বললেন, এত বড় ক্লায়েন্টকে আমরা অখুশি রাখতে পারি না। তাই তোমাকেও আমি ছাড়ছি না। জয়েন করতেই হবে। বললাম, আমি থাকি শিকাগোতে। সেখানে আমার বউ রেসিডেন্সি করছে। বাড়িতে ছোট বাচ্চা। বস বললেন, কোনো চিন্তা নেই। শোন, তুমি যা মাইনে পেতে, তার থেকে বছরে ১০ হাজার ডলার বাড়িয়ে দেব। আরও ৪৫ ডলার করে ডেলি অ্যালাউন্স দেব। তোমার মাইনেতে হাতও দিতে হবে না। আর তোমার বউ যাতে এখানে রেসিডেন্সি পায়, তার ব্যবস্থাও আমি পি অ্যান্ড জি ম্যানেজমেন্টকে বলে করিয়ে দেব। এখানকার হাসপাতালগুলোর বাজেটের লায়ন শেয়ার তো পি অ্যান্ড জি দিয়ে থাকে। ওরা এই কোম্পানির কথা ফেলতে পারবে না। তা ছাড়া এখানকার কস্ট অব লিভিং খুবই কম। তুমি অনেক টাকা বাঁচাতে পারবে। বাচ্চার জন্য তুমি ন্যানি ও টিউটরও রাখতে পারবে। বাড়িতে ফিরে গিয়ে সোজাসুজি এ কথা বউকে যে বলব, আমার ঘাড়ে কটা মাথা? মিনমিন করে পেশেন্ট বেডে এক ড্রপ করে স্যালাইনের ডোজ দেওয়ার মতো ওইটুকু কথা ধীরে ধীরে শেষ করতে রাত ফুরিয়ে গেল। জেতার প্রশ্ন তো আসেই না। মান বাঁচিয়ে শেষমেষ রফা হলো, দুই মাসের জন্য গিয়ে দেখা যাক। যদি ঠিকমতো রেসিডেন্সি পাওয়া না যায় বা মন না টেকে, তাহলে শিকাগো ফেরত চলে আসব। টুন্খানক শহরটা আপাতত পাণ্ডব বর্জিত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তেমন খারাপ কিছু নয়। এটি নর্থ ইস্ট পেনসিলভানিয়ার একটি পাহাড়ি রিসোর্ট এরিয়া। শুধু সুন্দর নয়, একেবারে নয়নাভিরাম। যেদিকেই দৃষ্টি যায়, প্রাকৃতিক উঁচু নিচু সবুজ পাহাড়ি দৃশ্যপট। শহরের মাঝখান দিয়ে পাহাড়ি নদী সাস্কেহানা (Sasquehana) বয়ে গিয়েছে। লোক বসতি কম। যারা আছেন তাদের শতকরা ৯৫ ভাগই পি অ্যান্ড জির কর্মচারী। সবাই বাইরের, মানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন বলে খুব বন্ধুসুলভ। লোকাল-আউটসাইডার, এই টাগ-অব-ওয়ারটা নেই। কোম্পানি কোয়ার্টার ছাড়া ওখানকার অন্যান্য বাড়ির মালিকেরা প্রায় সবাই রিটায়ার্ড বা রিটায়ার্ড করতে যাচ্ছেন। যারা এখনো চাকরি করছেন, তারা পরে এসে এখানে বাকি জীবনটা কাটাবেন, এই প্ল্যান। জায়গাটা থেকে নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি ও পিটর্সবার্গ শহরে যেতে লাগে দুই ঘণ্টা। মুশকিল হলো সারা শহরের সোকলড ডাউন টাউনে তার দিয়ে ঝোলানো একটাই মাত্র ট্র্যাফিক লাইট। বউ বলল, ছোট একটা বাচ্চা, তাকে যে একটু ম্যাকডোনাল্ডসে নিয়ে যাব, তো একটা ম্যাকডোনাল্ডসও এখানে নেই। এ কোন বনবাদাড়ে আনলে? চল, ফিরে চল। শুনে মনে মনে প্রমাদ গুনলেও ভেবে দেখলাম, কথাটা তো সত্যি। খালি নিজের চাকরির কথা ভাবছি আর ভালো ভালো পয়েন্ট উদ্ভাবন করে ওর সামনে তুলে ধরছি। বউ যে এই রিমোট একটা জায়গায় সারাটা দিন ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে একা থাকে, সে চিন্তা তো করে দেখিনি। তা ছাড়া বাচ্চাটাকে যে একটু কাছাকাছি কোনো জায়গায় নিয়ে, সে যে একটু গুড টাইম দেবে তারও উপায় নেই। এ ছাড়া আমি কাজ থেকে বাড়ি ফিরেই আবার নাইট কলেজ করতে যাচ্ছি এবং রাত এগারোটায় ফিরছি। শুধু তাই না, ভুলে বলে দিয়েছি যে, ওতো (স্ত্রী) আর ঠিক হাউস ওয়াইফ নয়, নিজেই একটা প্রফেশনাল। মনে পড়ল, শিকাগো ছাড়ার সময় মেয়ের জন্মদিন করেছিলাম। তাতে এক-দেড় শ লোক হয়েছিল। অথচ, এখানে আসার পর মেয়ের জন্মদিন যখন করতে যাব, দেখলাম নিমন্ত্রণ করার মতো একজন লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নিকটবর্তী বড় শহর স্ক্র্যানটন (Scranton) ঘেঁষা এলাকা ক্লার্কস্ সামিটে (Clarks Summit) মুভ করলাম। উডেডলটের মধ্যে বেশ সুন্দর একটা সুন্দর টাউন হাউস নিলাম। থ্যাংক গড, এখানে বউয়ের কিছুটা মন বসল। নম নম করে মেয়ের জন্মদিনটা সারতে নিমন্ত্রণ করার জন্য কিছু লোকজনও পাওয়া গেল। কিন্তু লোকগুলো যেন কেমন-কেমন, উদ্ভট চিড়িয়া একেকজন। একজন ছিলেন লিবিয়ার। জিজ্ঞেস করলে খুব মজা করে বলতেন, মাই নেম ইজ বেঙ্গলি। জোরেশোরে চেপে ধরলে বলতেন, আসলে আমার নাম বেন গালি। আমেরিকায় আছি অনেক দিন হলো। কিন্তু কিছুতেই যাতে ফেরত না যেতে হয় সেই সব ফন্দি এঁটে চলেছি। কি করে, কথাটা জিজ্ঞেস করার আগেই বলতেন, আমি ইউটা (Utah) স্টেটের ব্রিঘাম ইয়াং (Brigham Young) ইউনিভার্সিটির পিএইচডি প্রোগ্রামের ছাত্র। কিন্তু পিএইচডি করতে চাই না। কারণ করলেই ফেরত চলে যেতে হবে। তা কীভাবে সামলাচ্ছ, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, প্রতি সেমিস্টারে আমি ভর্তি হই। তারপর এক মাসের মধ্যে উইথড্র করি। আবার পরের সেমিস্টারে ভর্তি হই। এতে পুরো পয়সাটাও উঠিয়ে নেওয়া যায়, সময়টাও লিংগার করা যায়। কেমন, সোজা না? বেন গালি আরব হসপিটালিটিতে খুব বিশ্বাস করত। আমার বউয়ের ঢাকাই বিরিয়ানি ও অন্যান্য খানদানি রিচ খাবার মুখে তুলতে পারতেন না, কিন্তু সব সময় নিমন্ত্রণ করতেন। যেতেই হবে, ছাড়াছাড়ি নেই। খাবার হলো টার্কি বিরিয়ানি। ব্যাস, একটাই আইটেম! মোটা চাল, মসলা প্রায় নেই বললেই হয়। টার্কির গন্ধে নাকে মুখে রুমাল দিয়ে খাবার অবস্থা। অথচ তাতো করা সম্ভব ছিল না। হঠাৎ একদিন দেখা গেল ১০ বছরের জং ধরা, ঝরঝরে একটা গাড়িতে মালপত্র চাপাচ্ছেন। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে বললেন, আমরা লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে যাচ্ছি। বললাম, হঠাৎ? তা ছাড়া তিন বাচ্চা, বউ ও এত মালপত্র নিয়ে অত দূর ড্রাইভ করে যাবেন এই গাড়িতে? বেন বললেন, বিলিভ মি, ইট ইজ রিয়েলি এ স্ট্রং কার। বললাম, দুই দিনের পথ। তুমি একাই ড্রাইভ করবে? বেন গালি একগাল হেসে বললেন, ইট ইজ নাথিং। একনাগাড়ে ড্রাইভ করে একদিনেই চলে যাব। ওই একেবারে ভাঙা ঝরঝরে গাড়ি নিয়ে প্রায় ২৪০০ মাইল সে একা একদিনে ড্রাইভ করে কী করে যাবে সে কথা ভাবতে তৎক্ষণাৎ আমার গা শিউরে উঠেছিল। আরেক বাঙালি ভদ্রলোক ছিলেন, মিস্টার বা ডক্টর বোস, এমবিএ ক্লাসের অধ্যাপক। কেবল ওই টেক্সট বুক ছাড়া তাঁর আর কোনো শখ ছিল কিনা বোঝা যেত না। স্ত্রী এমএ পাস। হাউস ওয়াইফ। ছেলে কলেজে, অন্য স্টেটে। হাতে অফুরন্ত সময়, অথচ শত চেষ্টা করেও আমার বউ তার (অধ্যাপকের স্ত্রী) সঙ্গে কোনোমতেই বন্ধুত্ব পাতাতে পারল না। আরও একজনকে পাওয়া গেল। তারা মূলত আফগানিস্তানের লোক, পেশোয়ারে পড়াশোনা করতে করতে ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন। উদ্ভট ইংরেজি উচ্চারণ। উত্তরকে বলতেন নারতা, দক্ষিণকে বলতেন সাউতা। নিজের মনে একটানা খাপছাড়া গল্প করে চলতেন, কেউ কান দিচ্ছে কী দিচ্ছে না, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনের কারওর কথায় কোনো রস কস কেউ খুঁজে পায়নি। আরও একটা ফ্যামিলিকে পাওয়া গেল। তিনি ইউনিভার্সিটি অব স্ক্র্যান্টনের ফিজিকসের অধ্যাপক। হাসান সাহেব হলেন একজন পাঞ্জাবি পাকিস্তানি। খুব সিরিয়াস মানুষ। ভদ্রলোক আমাদের একদিন দাওয়াতও করেছিলেন। বাড়িতে ঢুকে দেখি একেবারে প্রিন্ট অব সাইলেন্স। খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে এমন ছবির মতো সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, খাওয়া তো দূরের কথা, বসতেই ভয় করছিল। খাবার মাঝখানে হঠাৎ তিনি ভীষণ চিৎকার করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। গোস্তাকিটা কি বা কার কোথায় হয়েছে তা না বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পাঁচ ছয়টি ড্রয়ার খোলা বন্ধ করে শেষ পর্যন্ত একটা চামচ বের করলেন। প্রতিটি খাবার প্লেটে আলাদা আলাদা খাবার। তার জন্য অ্যাকজ্যাক্টলি যে যে চামচটি দেওয়ার কথা, তার বউ এত দিনেও সেটা কেন শেখেননি, এটাই ওনার রাগের কারণ। এত বড় বেয়াদব, জংলি, আনকালচার্ড বউ কারও হয়? ফেরার পথে বউকে বললাম, কি ব্যাপার বলত? একটা সামান্য চামচের জন্য একেবারে নতুন অতিথিদের সামনে স্ত্রীকে ওভাবে কেউ কান ধরে উঠবোস করায়? বউ বলল, ওদের কথা আর বলো না। আমার সঙ্গে ওনার স্ত্রী পারভিনের অনেক কথা হয়েছে। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস। ওই ভদ্রলোকের আগের পক্ষের বড়সড় একটা ছেলেও আছে। সে কোন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল না কলেজে যেন পড়ে। মেয়েটি তা জানত না। হাসান সাহেব বলেছেন, তাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হতে পারবে না। কারণ ওনার দরকার নেই। অধ্যাপনায় মাইনে কম বলে ক্যারিয়ার চেঞ্জ করার জন্য উনি আবার এমবিএ পড়ার জন্য লিহাই (Lehigh) ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন। সে জন্য সারা রাত জেগে পড়াশোনা করেন। আর পারভিনকেও সারা রাত না ঘুমিয়ে খাটের নিচে বসে থেকে, সেলাই টেলাই করে সময় কাটাতে হয়। তারপর উনি সকালে কিছুটা ঘুমিয়ে, হয় পড়াতে, নয় পড়তে বেরিয়ে যান। তখন পারভিন ঘুমায়। তার মানে রাত জেগে না পড়ে, বিছানায় শুয়ে পড়ার পর যদি পারভিন বাতি নিভিয়ে দেয়, তখন হাসান সাহেবের সমূহ বিপদ বলছ? তুমি না, একটা যা তা। মুখের কোনো লাগাম নেই। এখন এই পাগলা গারদ থেকে জলদি আমাদের বেরোবার চেষ্টা কর তো বাপু। তথাস্তু, ম্যাডাম। সে আর বলতে? এক মাসের মধ্যেই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.