বাংলাদেশ: ২৮৯ ও ১৭৩
নিউজিল্যান্ড: ৩৫৪ ও ১১১/১ ফল: নিউজিল্যান্ড ৯ উইকেটে জয়ী বৃষ্টি কি একটা ধন্যবাদ পেতে পারে? ধরুন ম্যাচের তৃতীয় দিনে বৃষ্টি হয়নি। সারা দিন খেলা হয়েছে। ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট কি তাহলে চতুর্থ দিনের আলো দেখত? কালই টেস্টের দফারফা হয়ে যাওয়ায় এটা এখন পরিষ্কার, দ্বিতীয় দিন শেষে আসলে এক দিনেরই খেলা বাকি ছিল। বৃষ্টি সেই এক দিনের খেলা ভাসিয়ে নিয়ে এল চতুর্থ দিনে। কিন্তু বৃষ্টির হাত থেকে ব্যাটনটা বাংলাদেশ ঠিকঠাক নিতে পারল না। রিলে রেসের শেষ ল্যাপে পেছাতে পেছাতে দলটি এতটাই পিছিয়ে গেল যে, বৃষ্টি এক দিন এগিয়ে দেওয়ার পরও পঞ্চম দিনের আগে খেলা শেষ। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতার নিয়ম রক্ষা করে ৯ উইকেটে হার। সফরের সব ম্যাচ হেরে ৮-০-র লজ্জা নিয়ে কাল দেশে ফিরবে বাংলাদেশ দল। বেসিন রিজার্ভ ফিরে এল হ্যাগলি ওভালে। পার্থক্য হলো, ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংস সবাইকে অবাক করেছিল। প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রান করা দল কীভাবে দ্বিতীয় ইনিংসে ওভাবে ধসে পড়ে! ক্রাইস্টচার্চে সেই বিস্ময়টাই রইল না। ধসে পড়াটাই যেন স্বাভাবিক। বাংলাদেশের দেওয়া ১০৯ রানের লক্ষ্য নিউজিল্যান্ড হাসতে-হাসতে, নাচতে-নাচতে পেরিয়ে গেল কালই। সেটাও কী দুর্দান্ত ভঙ্গিমায়! নাজমুল হোসেনের পর পর দুই বলে মিড উইকেট এবং লং অনের ওপর দিয়ে দুই ছক্কা মারলেন কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম। টেস্ট ম্যাচও এভাবে জেতা যায়! জেতা যায়। প্রতিপক্ষ যতবারই ফণা তুলুক, ততবারই তাদের টুঁটি চেপে আছড়ে ফেলা যায়। যখন তারা থাকে পরিকল্পনাহীন, এলোমেলো। সবচেয়ে বড় কথা, যখন তারা হারের জন্য মনস্থির করে ফেলে। ভালো কিছুর আকাঙ্ক্ষা শরীরী ভাষা থেকে হারিয়ে যায়। ফিল্ডিংয়ে ভুলের ছড়াছড়ি সফরের শুরু থেকে। সেই ভুল মুক্তি দেয়নি শেষ দিনেও। তাসকিন আহমেদের বলে গালিতে নিল ওয়াগনারের ক্যাচ নাজমুল হোসেনের হাত ফসকাল। এর আগে কামরুল ইসলামের বলে দ্বিতীয় স্লিপে আউটের সুযোগ দিয়ে টিম সাউদিও বেঁচে যান মেহেদী হাসানের হাত থেকে। দ্বিতীয় দিনসহ সব মিলিয়ে এই এক ইনিংসেই বাংলাদেশ নিশ্চিত ক্যাচ ছেড়েছে ছয়টি। অর্ধেক সুযোগগুলোর কথা বাদই দিন। তাতে নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংসে শেষ তিন উইকেটে করে ফেলল ৯৮ রান, যার ৫৭-ই এসেছে হেনরি নিকোলস আর ওয়াগনারের নবম উইকেট জুটিতে। ২৫৬ রানে ৭ উইকেট হারিয়েও তাদের প্রথম ইনিংসের স্কোর ৩৫৪। ৬৫ রানে পিছিয়ে থাকলেও তখন পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু থেকেই ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগল। প্রথম পাঁচ উইকেট নেই ১০০ রানে, পরের পাঁচ উইকেট মাত্র ৭৩ রানে। অধিনায়ক তামিম ইকবাল সময়ের আগে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। ফলাফল হাতেনাতে। টিম সাউদির শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে মিচেল স্যান্টনারের সহজ ক্যাচ। ড্রয়ের জন্য হলেও তামিমের উইকেটে থাকাটা জরুরি ছিল। অধিনায়ক হিসেবে উচিত ছিল আগে অন্তত রানের ঘাটতিটা দূর করে তারপর শটের ভান্ডার খোলা। সেটা করতে না পারায় দিন শেষে নিজেকেই নিজে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন তামিম। স্বীকার করে নিলেন অনিষ্টের শুরুটা তাঁর হাতেই। উইকেটে বোলারদের জন্য কিছুই ছিল না। ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য প্রলোভন। রান করার, ভুল করারও। তামিমের মতো সাকিব আল হাসান, সৌম্য সরকাররাও দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিলেন। সাকিবকে দ্বিতীয় বলেই স্লিপে জীবন দিলেন জিত রাভাল। কিন্তু জীবনের মূল্য তাঁর কাছে কী? নিজের ৮ রানের মাথায় অনেকটা ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেরই পুনরাবৃত্তি করলেন। কাটের মতো করতে গিয়ে আধাআধি এক শট। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে গ্র্যান্ডহোমের ক্যাচ। বলটা আহামরি নয়। সাউদি তবু সাকিবের আউটটা মনে রাখবেন। টেস্ট ক্রিকেটে যে এটি তাঁর ২০০তম শিকার! নিউজিল্যান্ডের স্পিনাররা যথারীতি এই ইনিংসেও অলংকারই থেকে গেলেন। চার পেসারেই শেষ বাংলাদেশ। বড় কোনো জুটি নেই, নেই বড় ইনিংস খেলার তাড়না। কী এক বিশৃঙ্খল মানসিকতা নিয়ে ব্যাট চালালেন সবাই। মাহমুদউল্লাহ, সাব্বিরদের আউটগুলোকে হয়তো বাজে বলা যাবে না, কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে নিউজিল্যান্ডে এতগুলো ম্যাচ খেলার পরও এখানকার কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় ফাঁক থেকে গেছে। মাহমুদউল্লাহ বারবারই শরীর সামনে না নিয়ে ব্যাট চালাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেটিরই মাশুল গুনে ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে বোল্ড। ওয়াগনারের শর্ট বলের শিকার সাব্বির। মিডল স্টাম্পের লাইনে পড়ে ওপরে উঠে আসা বলটা নিচে নামাতে গিয়ে কট বিহাইন্ড। ইনিংসের ৪০তম ওভারে নাজমুল হোসেনের বোল্ড হওয়ার সময় দিনের খেলা বাকি ৩৪ ওভারের মতো। প্রেসবক্সে শুরু হয়ে গেল ওভার আর সময়ের হিসাব। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট করে নিউজিল্যান্ড কি পারবে চতুর্থ দিনেই খেলার শেষ টানতে? বাংলাদেশের লিড তখন মাত্র ৪১ রান। ১০৬ রানে ৭ উইকেট নেই। শেষ তিন উইকেটে আর কতই বা হবে! তাসকিন আহমেদ আর কামরুল ইসলাম মিলে অবশ্য এই ধারণা কিছুটা ভুল প্রমাণ করলেন। নবম উইকেটে তাঁদের ৫১ রানের জুটিটাই বৃহত্তম এবং এটাই বড় বড় ব্যাটসম্যানদের জন্য লজ্জার। দুই ছক্কাসহ তাসকিন ৩০ বলে ৩৩। কামরুলের ২৯ বলে অপরাজিত ২৫ রানে ছক্কা একটি। ১১৫ রানে ৮ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে তাঁরাই নিয়ে গেলেন ১৭৩ রানে। তবু নিউজিল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়াল মাত্র ১০৯। হাতে এক দিনেরও বেশি সময় এবং ১০ উইকেট। তারা অবশ্য দিন শেষ হওয়ার আগেই ওপেনার রাভালের উইকেটটি হারিয়ে তুলে নিল জয়। মূলত ডি গ্র্যান্ডহোম-ঝড়েই ম্যাচের দ্রুত সমাপ্তি। শেষ দুটি ছক্কাসহ ১৫ বলে অপরাজিত ৩৩ রানের ইনিংসে ছক্কাই চারটি। বাংলাদেশ এর মধ্যেও সহজ ক্যাচ ফেলল। স্লিপে এবার টম ল্যাথামকে জীবন দিলেন সাকিব। ব্যাটিং-ফিল্ডিংয়ের ব্যর্থতার অন্ধকারে উজ্জ্বল শুধু বোলারদের সাফল্য। সাকিবের ৪ উইকেটের সঙ্গে তিন পেসার তাসকিন-রুবেল-কামরুলের বাউন্স আর গতির সামনে কিউই ব্যাটসম্যানরা কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ছিলেন। নিউজিল্যান্ড সফরে তাঁরাই মাঝেমধ্যে একটু আশা জাগাতে পেরেছেন। সেটা এমনকি শেষ ম্যাচেও! বৃষ্টির সঙ্গে তাই বোলারদেরও ধন্যবাদ পাওনা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.