বহুল আলোচিত যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশের ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি বাতিলে স্বস্তি ফিরেছে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, এর ফলে বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মত সমান সুযোগ পাবে। অর্থনীতিবিদরাও টিপিপি বাতিলকে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, টিপিপি চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশ অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ত। টিপিপিভুক্ত প্রতিযোগী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেলেও বাংলাদেশকে সেখানে উচ্চ হারে শুল্ক পরিশোধ করে প্রবেশ করতে হতো। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য মার খাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধ পেত। এ জন্য সুবিধার একটি সাধারন নীতি অনুসরণ করতো। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এ চুক্তির আওতায় ছিল জাপান, কানাডা, ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, পেরু ও ভিয়েতনাম। চুক্তি স্বাক্ষরকারী ১২টি দেশ বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আর এসব দেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি।
এ চুক্তিতে বাংলাদেশের বড় আশঙ্কা ছিল ভিয়েতনামকে ঘিরে। কেননা দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। চুক্তিটি কার্যকর হলে ভিয়েতনাম সেখানে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেলেও বাংলাদেশকে প্রায় ১৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হতো।
গত সোমবার প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে চুক্তিটির বাস্তবায়ন কার্যত থেমে গেল। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার টিপিপিকে খুবই বাজে চুক্তি বলে উলেখ করেছিলেন। চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময়ও যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিল ওবামা সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে এই চুক্তির বিরোধীদের মূল যুক্তি ছিল, এটি মার্কিন শ্রমবাজার, এমনকি স্বার্বভৌমত্বের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, টিপিটি আমাদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছিল। চুক্তিটি বাতিলের সিদ্ধান্তে এখন স্বস্তি ফিরেছে। চক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে ইতিমধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে ব্যবসা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছিলাম। এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি কমলেও ভিয়েতনামের বেড়েছে। আশা করছি, এখন সব দেশই সমান প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকব। এ ধরণের চুক্তি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নীতিমালার আলোকে হওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রে স্থগিত হওয়া জিএসপি (শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা) বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেয়া এবং ওই জিএসপিতে তৈরি পোশাক খাততে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ সুবিধা প্রাপ্য। অন্যান্য এলডিসি এ সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ পাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, টিপিপির যে শর্ত ছিলো তাতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সুবিধা আদায় করতে পারতো। বহুজাতিক কম্পানিগুলো অনেক উন্নয়নশীল দেশের বাজারে হস্তক্ষেপ করে। টিপিপিভুক্ত দেশগুলো যে বাজার সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য ছিলো সেটি আর হচ্ছে না। ফলে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার আশংকা কমেছে।
টিপিপি’র ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই নয়, টিপিপিভুক্ত আরো কয়েকটি দেশেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে বাংলাদেশ কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারের। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৯ কোটি ডলার। এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। একইভাবে কানাডায়ও ২০১৩ সালে রপ্তানি ছিল ১০০ কোটি ডলার। পরের বছর তা নেমেছে ৯৩ কোটি ডলারে। টিপিপি’র উপর ভর করে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ভিয়েতনাম। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চালকের আসনে ছিল চীন ও বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন ওই স্টিয়ারিং ভিয়েতনামের হাতে। টিপিপির কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ভিয়েতনামমুখী হচ্ছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.