রাতারাতি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মুনিরা আহমেদ (৩২)। নতুন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেয়ার পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে নারীদের যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়েছে তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন মুনিরা। সংক্ষেপে বলা যায়, ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভের প্রতীকী মুখ হয়ে উঠছেন এই যুবতী। প্রতিবাদী নারীরা ২১শে জানুয়ারি যে যুবতীর পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তিনি আর কেউ নন, এই বাংলাদেশি মুনিরা। মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা দিয়ে স্কার্ফ পরা তার একটি ছবিকে ব্যবহার করে বানানো হয় ওই পোস্টার। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে, মানুষের হাতে হাতে বিক্ষোভের দিনে ঘুরেছে এ পোস্টার। এমনকি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পূর্ণ পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয় মুনিরার ওই পোস্টার। এ বিষয়ে মুনিরা আহমেদ বলেছেন, এই ছবিটি দিয়ে যা বোঝানো হচ্ছে তার জন্য তিনি গর্ববোধ করছেন। তার ভাষায়, এটা কোনো কিছুর বিরোধিতা নয়। এটা হলো সবাইকে নিয়ে চলার প্রতীক। এ ছবিটি যেন বলছে, তুমি যেমন তেমনি আমিও একজন মার্কিনি। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে। গতকাল লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের অনলাইন সংস্করণে তাকে নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিখেছেন সাংবাদিক এডওয়ার্ড হেলমোর। এতে বলা হয়েছে, মুনিরার ওই ছবিটিতে দেখা যায় তিনি প্রতিরোধের একটি প্রতীক যেন। তিনি যে হিজাবটি পরেছেন তাতে রয়েছে স্টার ও স্ট্রাইপস। এটি তৈরি করেছেন আর্টিস্ট শেপার্ড ফেয়ারি। তিনি সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আশা জাগানিয়া বার্তা ‘হোপ’ নিয়ে তার পোট্রেট করার জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। উই দ্য পিপল নামের অধীনে অ্যাপ্লিফায়ার ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ে যে গ্রুপটি পরিচালিত হয় তার অংশ শেপার্ড ফেয়ারির ওই পোট্রেট। মুনিরা আহমেদ ওয়াশিংটনে যোগ দিয়েছিলেন ওমেন্স মার্চ বিক্ষোভে। সেখান থেকে নিউ ইয়র্কে ফেরার পর পরই তিনি মুখোমুখি হন গার্ডিয়ানের সাংবাদিক হেলমোরের। তাতে তিনি বলেন, আপনি জানেন আমি একজন মার্কিনি। আমি একজন মুসলিম। এ দুটি পরিচয়ের জন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত। উল্লেখ্য, গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে যে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ হয় তাতে প্রতিবাদীদের হাতে হাতে দেখা গেছে মুনিরা আহমেদের ওই পোট্রেট দিয়ে বানানো পোস্টার। ওয়াশিংটনের বিক্ষোভ সম্পর্কে মুনিরা আহমেদ বলেন, একজন কংগ্রেসওমেন আমার কাছে এলেন এবং বললেন তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। ওই পোস্টারে যে ছবিটি রয়েছে সেটা আমি। আমি তার কথায় বিস্মিত হলাম। কারণ, আমি ভেবেছিলাম লোকজন মনে করবে এটা কে না কে, হিজাব দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। মুনিরা বললেন, শেপার্ড ফেয়ারি যে ছবিটি তার পোট্রেটে ব্যবহার করেছেন এটা এক দশক আগের। ছবিটি তুলেছিলেন নিউ ইয়র্কভিত্তিক ফটোসাংবাদিক রিদওয়ান আদামি। তিনি এসেছিলেন কুইন্স থেকে। ওই ছবিটি তুলতে তিনি ও মুনিরা আহমেদ গিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে। মুনিরা আহমেদ একজন ফ্রিল্যান্সার ট্র্যাভেল ফটোসাংবাদিক। কুইন্সের জ্যামাইকাতে ডনাল্ড ট্রাম্প যেখানে জ্যামাইকা এস্টেট গড়ে তুলেছেন তার খুব কাছেই বড় হয়েছেন মুনিরা। ১৯৭০-এর দশকে তার পিতামাতা বাংলাদেশ ছেড়ে যান। এরপর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই জন্ম মুনিরার। এরপর পরিবারের সদস্যরা মিশিগানে সেটেলড হয়ে যান। মুনিরা বললেন, এই ছবিটিতে রয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জীবন। এটি ভাইরাল হওয়ার আগেই ভাইরাল হয়েছে। যখন এটি একটি মুসলিমবিষয়ক ব্লগে পোস্ট করা হয় তখন অনেকেই ছবিটিকে পছন্দ করেছে। এটা ভাইরাল হয়ে গেছে। এখন এটির তৃতীয় জীবন চলছে। তবে আগে এটা যতটা জনপ্রিয় হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এখন। ফেয়ারির পোট্রেট ও রিদওয়ান আদামির ফটোগ্রাফের পোজ একই প্রশ্ন তুলে ধরে। তা হলো যুক্তরাষ্ট্র যখন বেশির ভাগ মুসলিম দেশে সংঘাতে লিপ্ত তখন মুসলিম ও আমেরিকানদের সম্পর্ক কি হবে। রিদওয়ান আদামি গার্ডিয়ানকে বলেছেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়া। তাই আমরা এ ছবিটি ধারণ করতে গ্রাউন্ড জিরোতে গিয়েছিলাম। আমরা এর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছি: আমরা এখানে আছি। আমরা মুসলিম। আমরা নিউ ইয়র্কার। এ দেশে আমরাও অধিকার রাখি। তবে আমার জীবনের বড় কাজ হলো ৪০ ওয়াল স্ট্রিটে ডনাল্ড ট্রাম্পের মালিকানাধীন একটি ভবনকে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর বর্ণবাদ, বিভিন্ন বর্ণের মানুষের পরিচয় এবং এ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছেন মুনিরা আহমেদ ও রিদওয়ান আদামি। মুনিরা আহমেদ ২০শে জানুয়ারি ডনাল্ড ট্রাম্পের শপথ বর্জন করেন। তিনি বলেছেন এটা স্বেচ্ছায়ই তিনি করেছেন। তার ভাষায়, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, এখনো এমন মানুষ আছেন যারা মনে করেন ভিন্ন ‘অরিজিনের’ মানুষকে বাদ দিয়ে রাখতে হবে। আমার দৃষ্টিতে এটা যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে অভিবাসীদের দ্বারা। তাই নির্বাচনী প্রচারণার সময় ডনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতির যে বন্যা বইয়ে দিয়েছেন তাতে উল্লেখযোগ্য হলো মুসলিমদের নিষিদ্ধ করা ও মুসলিম রেজিস্ট্রিতে অসামঞ্জস্য বজায় রাখা। যুক্তরাষ্ট্রকে মহৎ করেছে এর বহুত্ববাদ। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের যে বৈচিত্র্য রয়েছে তা বিশ্বের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। ওদিকে রিদওয়ান আদামি বলেছেন, ৯/১১-এর হামলার পর যে মুসলিম বিরোধিতার উত্থান হয় যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রতিবাদ জানানোর কথা আমার মাথায় আসে। তিনি মনে করেন, ওই সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য একজন মুসলিম হিসেবে যেন তিনি দায়ী এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে আপত্তিকর আলোচনা। রিদওয়ান আদামি বলেন, আরো অনেক মুসলিম আর্টিস্টের সঙ্গে তাই আমি কাজ শুরু করি। মুসলিমদের দেশপ্রেমের প্রশ্ন এলেই আদামি বলেন, তিনি বার বারই তার বন্ধুর ছবি পোস্ট করেন। প্রতিবারই তার এ বন্ধুর ছবি গভীর থেকে গভীর জনপ্রিয়তার দিকে যায়। তা শেয়ার হতে থাকে। বার বার পোস্ট হতে থাকে। গত বছর তিনি এ বিষয়ে যোগাযোগ করেন অ্যামপ্লিফায়ার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে। তারা উই দ্য পিপল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে। এ বিষয়ে শেপার্ড ফেয়ারি বলেছেন, আমেরিকার পতাকা দিয়ে হিজাব বানানো অত্যন্ত শক্তিশালী একটি কাজ। কারণ, এর মধ্য দিয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক নীতির অন্যতম হলো ধর্মীয় স্বাধীনতা। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের, বিশেষ করে যারা তার নিজের দেশে ধর্মীয় নিষ্পেষণের শিকার তাদেরকে স্বাগত জানানোর ইতিহাস আছে। এ বিষয়ে মুনিরা আহমেদ বলেছেন, ডনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণবাদের যে বিস্তার সে বিষয়ে তিনি চোখ বন্ধ করে রাখেন নি। বিশেষ করে মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপর নিষ্পেষণের বিষয়ে। তিনি বলেছেন, ২১শে জানুয়ারি যে বিক্ষোভ হয়েছে তা তার চিরদিন স্মরণে থাকবে। তিনি বলেন, আমি ভালোবাসা পেয়েছি। মনে হয়েছে আমি সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.