পুয়ের্তো রিকো, চিলি, পেরু-সহ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অরণ্য অধ্যুষিত এলাকায় বহু দিন থেকেই ছাগল কিংবা ভেড়ার মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছিল, যেগুলির কাঁধের কাছে রয়েছে দু’টি দাঁতের গভীর ক্ষতস্থান, এবং শরীরে এক ফোঁটা রক্ত নেই। প্রাণীদের নিথর দেহগুলি দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কেউ যেন তাদের ঘাড়ের কাছে কামড়ে দাঁত দিয়ে চামড়া ফুটো করে দেহের রক্ত চুষে খেয়েছে।
কিন্তু কোন প্রাণী এ ভাবে রক্ত চুষে খেতে পারে? পুয়ের্তো রিকো, চিলির গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দাদের উত্তর, ছুপাকাবরা। ছুপাকাবরা এক ভয়ঙ্কর প্রাণী। দূর থেকে দেখে জংলি কুকুর বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ছুপাকাবরা আসলে দু’পায়ে হাঁটে। বড় লেজ, প্রায় লোমহীন দেহ, আর বড় বড় চোখ, সেই সঙ্গে চোয়ালের ভিতরে বিভীষিকা জাগানো দাঁত। মেরুদণ্ডী এই প্রাণীর থাবায় রয়েছে তীক্ষ্ণ ধারসম্পন্ন নখের সারি। রাতের অন্ধকারে গবাদি পশুদের আক্রমণ করে ছুপাকাবরারা, তার পর প্রাণীটিকে হত্যা করে ঘাড়ের কাছে ফুটো করে তার রক্ত চুষে খায়।
কিন্তু প্রাণীবিজ্ঞানীরা তো এমন বিচিত্র, রক্তপায়ী কোনও প্রাণীর হদিশ জানেন না! স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যাখ্যা, বিজ্ঞান তো অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না। ছুপাকাবরার হদিশও বিজ্ঞানীদের অজানা।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পুয়ের্তি রিকো, চিলির গ্রামাঞ্চলে ছুপাকাবরার কাহিনি প্রায় কিংবদন্তির আকার নেয়। মাঝেমধ্যেই গ্রামবাসীরা দাবি করতেন, তারা জীবন্ত বিভীষিকা ছুপাকাবরাকে চাক্ষুষ করেছেন। কখনও বা জঙ্গলের ভিতর থেকে উদ্ধার হত বীভৎস-দর্শন প্রাণীদের মৃতদেহ। গ্রামবাসীরা দাবি করতেন, ওগুলো ছুপাকাবরারই দেহ। ‘দা কমিটি ফর স্কেপটিকাল এনকোয়্যারি’ নামের সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাণীবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন র্যাডফোর্ডকে ভাবিয়েছিল ছুপাকাবরা সংক্রান্ত এই সমস্ত কাহিনি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, সত্যিই কি ছুপাকাবরা বলে কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। প্রশ্নের উত্তর খুজতে তিনি অভিযান চালান নিকারাগুয়ার জঙ্গলে। অনুসন্ধানের ফলে যে সত্য তিনি আবিষ্কার করেছেন, তা শিউরে ওঠার মতো।
র্যাডফোর্ড জানাচ্ছেন, ‘আমি প্রথমেই ধরে নিয়েছিলাম যে, ছুপাকাবরা বলে কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব থাকতেই পারে, যার সন্ধান হয়তো এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা পাননি। কিন্তু যদি সেই প্রাণী সত্যিই থেকে থাকে, তা হলে তার নির্দিষ্ট ডিএনএ স্যাম্পেল, বোন স্যাম্পেল এবং মরফোলজিও নিশ্চয়ই থাকবে। ’
নিকারাগুয়ার জঙ্গলে যখন প্রবেশ করেন র্যাডফোর্ড তখন তার আশা ছিল, হয় ছুপাকাবরাকে সামনা সামনি দেখতে পাবেন, নয়তো মিলে যাবে তার মৃতদেহ। ছুপাকাবরার দেখা না পেলেও, কিছু অদ্ভুত-দর্শন প্রাণীর মৃতদেহের সন্ধান সত্যিই পেয়ে যান তিনি জঙ্গলের গভীরে। লোমহীন ও মোটা চামড়ার প্রাণীগুলির দেহ দেখলে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। তা হলে এগুলোই কি ছুপাকাবরার দেহ?
গবেষণাগারে গিয়ে পরীক্ষা করতেই উন্মোচিত হয় প্রকৃত সত্য। জানা যায়, মৃতদেহগুলির মধ্যে কয়েকটি জংলি কুকুরের, কয়েকটি কয়োটের (উত্তর আমেরিকার কুকুর জাতীয় প্রাণী), এবং বাকিগুলি র্যাকুনের। কিন্তু এই সমস্ত প্রাণীর মৃতদেহের সঙ্গে তো স্থানীয় বাসিন্দারা পরিচিত। তা হলে এই মৃতদেহগুলি দেখে তারা এত আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন কেন? র্যাডফোর্ড জানাচ্ছেন, আসলে মৃত্যুর আগে এই প্রাণীরা সার্কোপটিক ম্যাঙ্গি নামের এক চর্মঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এই রোগে প্রাণীদের দেহের সমস্ত লোম ঝরে যায়, এবং চামড়া মোটা যায়। ফলে এক বীভৎস আকার নেয় তাদের শরীর। কিন্তু তা হলে ওই রক্তশূন্য গবাদি পশুদের মৃতদেহগুলির ব্যাখ্যা কী?
র্যাডফোর্ডের বক্তব্য, ওগুলো জংলি কুকুরের কীর্তি। জংলি কুকুরেরা কোনও প্রাণীকে হত্যা করার জন্য তার ঘাড়ে কামড় বসায়। তাতে আক্রান্ত প্রাণীদের ঘাড়ের কাছে চামড়ায় ফুটো হয়ে যায়। কিন্তু অনেক সময়ে কোনও প্রাণীকে আক্রমণের পরে সেটিকে ছেড়ে কুকুরেরা চলে যায়। ফলে ক্ষতস্থান থেকে ক্রমাগত রক্তপাত হয়ে মারা যায় ওই গবাদি পশুরা। পড়ে থাকে তাদের রক্তহীন প্রাণহীন দেহগুলি, যাদের ঘাড়ের কাছে দু’টি দাঁতের দাগ রয়েছে।
তথ্যসূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.