দুই দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক সূচকগুলোতে বাংলাদেশের যে উন্নতি হয়েছে, তা দেশ-বিদেশে সবার নজর কেড়েছে। বিষয়টি এই কলামেও অনেকবারই উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষি উৎপাদনে আমাদের সাফল্যের কথা নানাভাবে উঠে এসেছে। সেতু, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কাঠামোগত উন্নয়নও দৃশ্যমান। দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন বেড়েছে, সুপেয় পানির আওতা বাড়ছে। শিক্ষা ও কর্মজগতে নারীর অংশগ্রহণ বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। আরও নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন হচ্ছে। এটা উন্নয়ন ও অগ্রগতির রঙিন চিত্র। কিন্তু সেই সঙ্গে এর মান বাড়ানো এবং একে টেকসই করার কাজটাও জরুরি। এই কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি খাত একটি যুগান্তকারী রূপান্তরের সম্মুখীন হয়েছে। তা ঘটেছে দুইভাবে—একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কৃষিকে সহজ করতে এবং উৎপাদন বহুগুণ বাড়াতে সাহায্য করেছে আর অন্য দিকে এখানে বড় বিনিয়োগ আসতে থাকায় পারিবারিক চাষের ধারা ভেঙে ঐতিহ্যবাহী ছোট চাষি আজ খেতমজুরে পরিণত হচ্ছেন। তাঁদের মজুরি বাড়লেও কাজের সুযোগ কমেছে। আবার নির্ভরযোগ্য নিজস্ব খেতখামার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ফলে আয় বাড়লেও বিষয়সম্পত্তি কমেছে। মোটকথা, তাঁদের জীবন আগের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এই বাস্তবতায় গ্রামের তরুণদের ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ চিন্তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রথম পছন্দ ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে পাড়ি দেওয়া, বিকল্প হলো রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগরে ভাগ্যপরীক্ষায় নামা। তবে আজ শহরের মতো গ্রামেরও অনেক পরিবার কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা দিতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁদের জন্য কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশে এখন শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যার তুলনায় চাকরির বাজার যথেষ্ট সংকুচিত। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে শিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। তাঁরা অবশ্যই হতাশাগ্রস্ত, দিনে দিনে তাঁদের হতাশা বাড়ছে। ভাবুন, দেশে দুই কোটি হতাশ তরুণ রয়েছেন। বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আরও গভীরভাবে সমাজের কথা বা সমাজের প্রকৃত উন্নয়নের কথা ভাবা দরকার। খুব সাদামাটাভাবেও যদি দেখি, এত উন্নয়নের মধ্যেও ব্যক্তিগত ও সমাজের মধ্যে যেসব পরিবর্তন দেখা যায় তা উন্নতির পরিচয় দেয় না; বরং চিন্তার স্থবিরতা, পথভ্রান্তি ও অবক্ষয়ের কথা বলে। মানুষের পরিচয় তো তার পোশাক-আহার্য-ব্যবহার্য-বসতের মানদণ্ডেই কেবল বিচার হবে না, তার প্রকৃত বিচার হবে চিন্তা ও কাজের গুণগত মানদণ্ডে। যদি বলি, মানুষের মান মাপার সূচকগুলো হলো বিচক্ষণতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সহানুভূতি, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ ও দূরদর্শিতা; তাহলে আমাদের অবস্থানটা কেমন দাঁড়াবে? সেই মানদণ্ডে আমরা অধিকাংশই অকৃতকার্য কিংবা খুব নিম্নমান পাচ্ছি। ষাট বা সত্তরের দশকের তুলনায় সমাজে ধর্মান্ধতা অনেক বেড়েছে, সাম্প্রদায়িক মনোভাব সংখ্যাগুরুর চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। ওপরে ব্যক্ত দুই পর্যবেক্ষণের প্রমাণ হিসেবে দুটি দৃষ্টান্ত দেব। পাঠ্যপুস্তকে ভুলভ্রান্তির সমস্যার আড়ালে ঢাকা যাবে না ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের সম্পূর্ণ নতি স্বীকারের ঘটনাটি। এটি বাঙালি সমাজের পশ্চাদপসরণের এক অকাট্য দৃষ্টান্ত কেবল নয়, এ তো বস্তুত হেফাজতের জয়ভেরি। একে অত্যুক্তি বলা যাবে না, কারণ ওরা তাদের দাবি শতভাগ মেনে নেওয়ায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং প্রত্যাশিতভাবেই শিক্ষানীতি বাতিলসহ জাতির পশ্চাদযাত্রা নিশ্চিত করতে তাদের আদর্শিক মৌলিক দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে এবার। দ্বিতীয় বক্তব্যটা ছিল সাম্প্রদায়িক মনোভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়ার বিষয়ে। হ্যাঁ, এখন উচ্চবিত্ত স্কুলের প্রাক-প্রাথমিক বা প্রথম শ্রেণির শিশুদের মুখেও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য শোনা যায়, আবার পোশাকেও এর প্রকাশ ঘটছে। বলা বাহুল্য, সব ক্ষেত্রে এর প্ররোচনা আসে সংখ্যাগুরুর দিক থেকে। যদি সমাজের সবচেয়ে আলোকিত ও অগ্রসর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের দিকে তাকানো যায়, তাহলেও মান, মনোভাব, চেতনার বিচারে হতাশ হতে হয়। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল এবং শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক দুর্নীতির প্রেক্ষাপটটা বাদ দেওয়া যাবে না। তবে মূল কথা হলো, পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে আসার ফলে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে অক্ষম। তাদের জ্ঞানচর্চার আকাঙ্ক্ষা কিংবা সক্ষমতা কোনোটাই তৈরি হয় না। ক্ষমা করবেন, এদের কি শিক্ষাপ্রতিবন্ধী বলা যাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালগুলো আপনাকে হতাশ করবে। আর ছাত্ররা কী করছে? পরীক্ষা দিচ্ছে, সেই বৈতরণি ভালোভাবে পার হওয়ার মোক্ষম পদ্ধতি তারা তো স্কুলজীবনেই শিখেছে—সম্ভাব্য প্রশ্ন জেনে তার উত্তর মুখস্থ করা। ফলে চকচকে ডিগ্রিও এসে যায় যথাসময়ে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দায়িত্বশীল কর্মীদের কাছ থেকে জেনেছি, ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েরই বই ব্যবহারের হার লজ্জাজনকভাবে কম। রবীন্দ্রনাথের ‘লাইব্রেরি শিক্ষক’ রচনার প্রথম পঙ্ক্তির বক্তব্যটি আমরা সুচারুভাবে সত্য করে তুলছি, বহুকালের জ্ঞান এখানে স্তব্ধ হয়ে আছে। আশা করি কেউ ইন্টারনেটে বইয়ের সন্ধান পাওয়ার দোহাই দিয়ে এই বাস্তব চিত্রে ফুটে ওঠা ব্যাধির গভীরতাকে খাটো করছেন না। এ-ও আশা করছি যে কেউই নিশ্চয় বিশ্বাস করবেন না, কেবল প্রশ্নের উত্তর শিখে (আমাকে শিক্ষকেরা জানিয়েছেন এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও জানি, অধুনা কেউই এত বোকা নয় যে মূল পাঠ্যবই পড়বে।) শিক্ষিত জাতি তৈরি হতে পারে। আর একে নিশ্চয় জ্ঞানচর্চা বলে সন্তুষ্টিতে ভুগব না আমরা। শিক্ষায়তনে সংস্কৃতিচর্চা নেই। অনেক বলাবলি, লেখালেখির ফলে কিছু ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে। সবাই জানি, স্কুল বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় কেবল সেরারাই অংশ নিতে পারে, আমছাত্ররা এর বাইরে থাকে। এটা অবশ্য স্পেশালাইজেশন বা বিশেষায়নের কাল, অর্থাৎ যে খেলে বা পারে, সে-ই খেলবে, গান-নাচ-নাটকেও ব্যবস্থা তা-ই। অথচ শৈশব তো কাটার কথা অংশগ্রহণের আনন্দে, সেই সুযোগ থেকে সিংহভাগকে বঞ্চিত রেখে ক্রীড়া বা সংস্কৃতিচর্চা হবে কীভাবে? এককালে ছোট-বড় সব গ্রাম-শহরেই এবং গ্রাম-শহরের ছোট-বড় সব স্কুলেই খেলাপাগল, নাটকপাগল, গানপাগল মানুষজন ছিল। তারা ও তাদের সঙ্গীরা মিলে একেকটি জনপদকে প্রাণবন্ত করে রাখত। বছরে একটা–দুটো নাটক, যাত্রার আয়োজন শীতকালে গ্রামের মানুষ নিজেরাই করত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বছরে কয়েক দিন উৎসবমুখর হয়ে থাকত। এখন সেসব বিগতকালের স্মৃতি। একই কথা বলা যাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো নিয়ে। ব্যান্ড সংগীতের কান ফাটানো শব্দদূষণ, টেলিভিশনের রঙিন নাটক-টক শো, পত্রিকার পাতায় তারকাদের বিচিত্র সাফল্যের জৌলুশ দেখে যেন সমাজের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে ভুল ধারণায় না ভুগি। আমাদের সমাজ সাংস্কৃতিকভাবে মরতে বসেছে, যদিও সংস্কৃতিই মানুষ ও সমাজের প্রাণ। কৃষকের গলায় গান নেই, জেলের কণ্ঠে ভাটিয়ালি নেই যেমন সত্য; তেমনি ছাত্রের হাতে বই নেই, কণ্ঠে গান নেই, নাটকের মহড়ায় তাদের ব্যস্ততা নেই, একুশের সংকলন প্রকাশের তাড়া নেই, লেখার ভূত মাথায় নেই। আজ পরীক্ষাই ভূতভবিষ্যৎ ও বর্তমান, তার ছাত্রজীবনজুড়ে একমাত্র সত্য হয়ে বিরাজমান। সংস্কৃতিহীন একালে জঙ্গিবাদ, গ্যাংস্টারিজম, মাদকের নেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে কিশোর ও তরুণেরা। আমাদের অজ্ঞাতসারে কলিকাল শুরু হয়ে যায়নি তো? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা আজ রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে শাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বটে, যা ভাবা যায়নি, তেমনি কাজ—যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিও দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র শক্ত হাতে আগলে রাখতে গিয়ে সমাজ যে হাতছাড়া হয়ে গেল! সমাজের যে জামায়াতীকরণ হয়ে যাচ্ছে, যার থাবার বাইরে নেই আওয়ামী লীগও! না, কেবল যে ভোল পাল্টে জামায়াতিরা লীগে যোগ দিচ্ছে তা নয় বা লীগের ওপর হেফাজত সওয়ার হয়েছে তা-ও নয়, খোদ আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা, চিন্তার পশ্চাত্পদতা ভর করেছে। একটি জাতির শিক্ষা ও রাজনীতি যদি আদর্শ ও সংস্কৃতিচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে তার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার তাল কেটে যায়। নাসিরনগর, হলি আর্টিজান চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় তাল কীভাবে কাটছে। ফাঁক অর্থাৎ দুর্বলতা অনেক সময় বোঝা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি সত্যিই আশ্বস্ত হওয়ার মতো দৃশ্য। একইভাবে শিক্ষামন্ত্রী যখন বছরের প্রথম দিনে ৩৬ কোটি বই নিয়ে কলকাকলিমুখর শিশুদের মাঝে উপস্থিত হন বা লাখ লাখ জিপিএ-৫ প্রাপ্তের ফলাফল নিয়ে হাসিমুখে হাসিখুশি প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করেন, তখন সবার মনে সুখানুভূতি হয়। কিন্তু বাস্তব তো সব সময় ছবির মতো নয়। এর যেমন লোক ভোলানোর ক্ষমতা আছে, তেমনি যাঁরা নিত্য এসব কথা বলছেন, এমন সাফল্য উদ্যাপনে ব্যস্ত থাকছেন, তাঁরাও বাস্তবতা ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ চোখে আর বিশ্লেষণী চেতনায় ফাঁক ও দুর্বলতা ধরা পড়বেই। নাহ্, সরকারকে হেফাজতের ধন্যবাদ এবং তাদের আরও উচ্চাভিলাষী দাবিকে কি খাটো করে দেখব? দেখা সম্ভব? কারণ তাদের দাবি মানতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালির শাশ্বত উদার মানবিকতার বাণী যে বিসর্জন দিতে হলো! সেটা কীভাবে মানা যাবে? সমাজে যখন চিন্তার জড়তা নামে, তখন কথার ফুলঝুরিও বাড়ে। চিন্তাহীনের মনে কথা ঘোর তৈরি করতে পারে। আর তখনই মানুষ অঘোরে মারা পড়ে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে না পেরে এমন অঘোরে মৃত্যুর বিপুল খেসারত এ জাতি অতীতে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায়? বারবার স্বেচ্ছায় যায় এ কেমন ন্যাড়া!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.