রড লেভার অ্যারেনায় অবশেষে ‘১৮’ এল নেমে! ১৮ এল রজার ফেদেরারের হাতে। দেখতে বাটির মতো, রুপালি রঙের যে ট্রফিটা কাল হাতে নিলেন সুইস কিংবদন্তি, সেটি তাঁর ১৮তম গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের স্মারক! সেটি এমনভাবেই এল যে এর চেয়ে ভালো কিছু হয়তো চাইতে পারতেন না ফেদেরার। ক্যারিয়ারজুড়ে যাঁর সঙ্গে দ্বৈরথ ছিল, যাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপহার দিয়েছেন একের পর এক ধ্রুপদি সব ম্যাচ, সেই রাফায়েল নাদালকে ৬-৪, ৩-৬, ৬-১, ৩-৬, ৬-৩ গেমে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতলেন ফেদেরার। স্বপ্নের ফাইনাল! ম্যাচের আবহে এই শব্দজোড়াই বারবার আসছিল ঘুরেফিরে। কোনো গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে আবারও যে ফেদেরার-নাদাল ম্যাচ হবে, এটিই তো ভাবা যাচ্ছিল না। চোট ভোগাচ্ছিল দুজনকে, তবে তাতে প্রায় দশকজুড়ে দুজনের ধ্রুপদি সব ম্যাচের স্মৃতি তো আর মুছে যায়নি। ম্যাচটাকে বলাই হচ্ছিল টেনিসের সর্বকালের সেরা বনাম তাঁর ‘নেমেসিসে’র লড়াই! স্বপ্নের ফাইনালের শেষটাও হলো কী নাটকীয়! শেষ সেটে ৫-৩ গেমে এগিয়ে ফেদেরার, ম্যাচের জন্য সার্ভ করবেন। দুবার তাঁর সার্ভে আম্পায়ার কল করলেন—বল দাগের বাইরে পড়েছে। দুবারই চ্যালেঞ্জ করে ফেদেরার জেতেন প্রথমবার। তৃতীয়বারে সার্ভিসে নয়, নাটক হলো ফেদেরারের রিটার্নে। নাদালের শটে দুর্দান্ত রিটার্ন করলেন সুইস কিংবদন্তি, নাদালের নাগালের বাইরে। গ্যালারির দর্শকও উল্লাসে ফেটে পড়ল। কিন্তু বল দাগের ভেতরে না বাইরে পড়েছে, তা দেখার জন্য ডাক পড়ল হক-আইয়ের। হক-আইয়ের সিদ্ধান্ত, বল দাগের ভেতর। এরপর…একমুহূর্ত থমকে থাকা। হয়তো ফেদেরার নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, কী হলো! সর্বশেষ ২০১২ উইম্বলডনের পর প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম! গ্র্যান্ড স্লামের হিসাব বাদ দিন, টেনিসে সর্বশেষ কোনো ট্রফি জেতার আনন্দও ছিল ১৫ মাস আগে। আরেকটি শিরোপা জিততে কোনো গ্র্যান্ড স্লাম চ্যাম্পিয়নের দীর্ঘতম অপেক্ষা। শিরোপা-তৃষিত ফেদেরারের মনে কাল বর্ষার প্রথম বৃষ্টি নামাল অস্ট্রেলিয়ান ওপেন! বৃষ্টির মতো না হলেও দুফোঁটা জল ঝরল তাঁর চোখেও। গত পাঁচ বছরে তিনবার গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে উঠেও হেরেছেন। আর একটি শিরোপার আকাঙ্ক্ষা যে কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে। অবশেষে সেটি এল, মেলবোর্ন পার্কে যেটি তাঁর পঞ্চম শিরোপা। সঙ্গে পাঁচটি ইউএস ওপেন ও সাতটি উইম্বলডন যোগ করে নিন—ওপেন যুগে তিনটি আলাদা গ্র্যান্ড স্লাম পাঁচবার বা তার বেশি জেতা প্রথম খেলোয়াড় ফেদেরার! ম্যাচটা অবশ্য ফেদেরার-নাদাল অন্য ক্ল্যাসিকগুলোর মতো দুর্দান্ত হয়নি। একটি সেটও যায়নি টাইব্রেকারে। বরং অনেকটা বক্সিংয়ের মতো, এক সেটে ফেদেরার ব্রেক করেন নাদালের সার্ভিস, তো পরের সেটে নাদাল ভাঙেন ফেদেরারের। প্রথম চার সেট পর তাই ২-২ সমতা। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেভাবে না থাকুক, আকর্ষণের কোনো কমতি ছিল না। ফেদেরারের দুর্দান্ত ফোরহ্যান্ড রিটার্ন বা এইস বলুন, আর নাদালের ক্রস কোর্ট রিটার্ন, দুজনের রুদ্ধশ্বাস র্যা লি—কী ছিল না! পঞ্চম সেটেই নাটকটা জমল সবচেয়ে বেশি। ফেদেরারের প্রথম সার্ভিসই ব্রেক করেন নাদাল। তখন মনে হচ্ছিল, এবারও বুঝি খালি হাতে ফিরছেন ফেদেরার। বয়সে ৩০ বছর বয়সী নাদালের চেয়ে বছর পাঁচেক বড় তিনি—পাঁচ সেট লড়াইয়ের ধকলটা তো কম নয়। তবে ঠিকই ফিরলেন চ্যাম্পিয়নের মতো! ৩-২ গেমে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় টানা দুবার নাদালের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যান। শেষ মুহূর্তের ওই নাটকীয়তার পর জেতেন ম্যাচও। স্বপ্নের ফাইনালে স্বপ্নের সমাপ্তি! তবে এখানেই শেষ নয়। কোর্টে দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য এই দ্বৈরথ বিখ্যাত, তবে সাধারণ টেনিসপ্রেমীদের মনে ফেদেরার-নাদাল বসতি গেড়েছেন তাঁদের বন্ধুত্ব দিয়েও। তাই হেরেও নাদাল বলে দিতে পারেন, ‘আমি ওর জন্য খুশি!’ তবে হার না মানার প্রতিজ্ঞা যাঁর রক্তে, নিজের রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে তাঁর খুশি থাকার কোনো কারণ নেই। সে জন্য মজা করেই রানার্সআপের প্লেটটা দেখিয়ে নাদাল বললেন, ‘এই ট্রফিটা সুন্দর, তবে ওটার (চ্যাম্পিয়নের ট্রফি) মতো নয়।’ আর ফেদেরার? জিতেছেন, কিংবদন্তি রড লেভারের হাত থেকে ট্রফিও নিয়েছেন। তবু বন্ধুকেও সম্মান দিতে ভোলেননি, ‘টেনিসে ড্র নেই। তবে ট্রফিটা ওর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ থাকলে আমি ড্র-ই মেনে নিতাম। এভাবেই খেলে যাও, রাফা। টেনিসের তোমাকে দরকার।’ রাতটাই তাঁর গৌরবে ভাসার, তবু নিজের অর্জন সম্পর্কে বলতেও যেন আপত্তি সুইস কিংবদন্তির, ‘আমি অনেক পরিশ্রম করি। কিন্তু সে তো আরও অনেকেই করে। খেলাটায় অনেক কিংবদন্তিও আছেন। আমার নিজের জন্য বললে, সর্বশেষ ছয় মাস অনেক কঠিন ছিল। নিশ্চিত ছিলাম না এতটুকু আসতে পারব।’ এত অপেক্ষা, এত লড়াইয়ের পর এসেছে বলেই হয়তো ফেদেরারের এই ‘১৮’ আরও বিশেষ! সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান। ১৮ উইম্বলডন ৭ ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৯, ২০১২ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ৫ ২০০৪, ২০০৬, ২০০৭, ২০১০, ২০১৭ ফ্রেঞ্চ ওপেন ১ ২০০৯ ইউএস ওপেন ৫ ২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.