এক দেশে একজন অসম্ভব ভালো বাবা ছিল আর তার একটা মোটামুটি ভালো মেয়ে ছিল। বাবা-মেয়ে দুজনই খুব বইয়ের পোকা। বাবা মেয়েকে প্রচুর বই উপহার দিত। যখনই বইমেলা হতো বাবা গাদাখাণিক বই কিনে দিত মেয়েটাকে। সে রকমই একটা উপহার দেওয়া বইয়ের মাঝে বাবা লিখে দিয়েছিল, ‘কোনো এক প্রাতে রইব না যখন এই আমি, তোর সকল সত্তায় থাকব জুড়ে সেই আমি!’ এর কিছুদিন পরেই এই লাইনগুলো মেয়েটার জীবনে সত্যি হয়ে গেল! তার বাবা মারা গেল।
মাইয়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। সোজা ভাষায় যেটাকে বলে হার্ট অ্যাটাক। বাবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ছিল। বাসার সবাই ভেবেছিল সেটারই ব্যথা বুঝি। অ্যান্টাসিডসহ গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সব দেওয়া হয়েছিল। কোনো লাভ হলো না। হসপিটালে নিতে নিতে সব শেষ।
এর পরের সময়গুলো মেয়েটার ভয়ংকর খারাপ কাটল। চোখের সামনে বুকের ব্যথায় ছটফট করতে থাকা বাবার মুখটা খালি ভাসে। যে বাবার সঙ্গে বিকেলবেলা একসঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে’ অথবা ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গান গাইত। যে বাবা সঞ্চয়িতা খুলে গভীর আবেগে মেয়েকে ‘দুই পাখি’, ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত এবং সেই ছোট্ট মেয়ে আর তার বাবা মোক্ষদা, রাখাল আর খাঁচার পাখির দুঃখে চোখের পানি ফেলত!
যে বাবা মেয়ের পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে নিজ হাতে দুটি লাইন লিখে টাঙিয়ে দিয়েছিল। একটি ছিল: ‘রাব্বি জিদনি ইলমা—হে প্রভু! আমার জ্ঞান তুমি বাড়িয়ে দাও।’ আরেকটি ছিল: ‘সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবাসিলাম!’
যে বাবা মেয়েকে বলত, মা, জীবনে কথা ও কাজে সব সময় সততা অবলম্বন করবে। যে বাবা বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে আগাছা পরিষ্কার করত। যে বাবা রাস্তায় পড়ে থাকা পানির খালি বোতল, চিপসের প্যাকেট কুড়িয়ে তুলত ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার জন্য।
এই ভালো মানুষ, পাগল কিসিম বাবাটা একদিন চিরতরে নাই হয়ে গেল। সেই বাবাটা নাই হয়ে গেল, যে বাবাটা তার মেয়েকে শোনাত, মা, তুমি একদিন নোবেল প্রাইজ পাবে এমনভাবে তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং ভাবতে শিখতে হবে!
কিশোরী মেয়ে প্রাণপণে মাথা নাড়িয়ে বাবাকে আশ্বাস দিত যে, সে অবশ্যই নোবেল পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। যদিও সেই কিশোরীর নোবেল প্রাইজের মাহাত্ম্যের চেয়ে দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব সিনবাদের পরের এপিসোডে কী হবে অথবা শাহরুখ খানকে কুছ কুছ হোতা হে মুভিতে কেন এত বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে কিংবা কাজল এত সুন্দর কেন এই সব চিন্তা বেশিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো।
যা হোক, সেই স্বপ্নচারী ও কন্যাকে স্বপ্ন দেখতে শেখানো বাবাটা একদিন পুরোপুরি হারিয়ে গেল মেয়েটার জীবন থেকে।
সময় গড়িয়ে গেল আর মেয়েটাও একদিন অনেক বড় হয়ে গেল। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধল। মেয়েটার কোল জুড়ে একদিন একটা ছোট্ট শিশু এল। এই মহাব্যস্ত মেয়েটার প্রায় প্রায়ই মনে হয়, এমন যদি হতো হয়তো কেউ একজন দরজায় নক করছে! মেয়েটা তার শিশু কোলে নিয়ে দরজা খুলল ও দেখল যে দরজায় তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে! শিশুপুত্র কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে দেখে বাবা কি চিনতে পারবে যে এই ভদ্রমহিলাই তার বহু বছর আগে শেষ দেখা ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটা!
বলাবাহুল্য এ রকম কখনোই হবে না। পৃথিবীকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে যাওয়া মানুষেরা কখনো আর পৃথিবীতে ফিরে আসেন না। এই কাহিনির এই মেয়ে আমি আর এই বাবা আমার বাবা। মাঝে মাঝেই মনে হয় কোনো একদিন কোনো এক ভুবনে নিশ্চয়ই দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী না দেখা বাবাটাকে আবার দেখতে পাব। কত শত কথাই না জমেছে এই এতগুলো বছরে। বাপ-বেটি মিলে খুব গল্প করব ওই দিন।
পৃথিবীর সকল বাবারা ভালো থাকুন। পরম করুণাময় তাদের সুস্থ রাখুন, ভালো রাখুন।
তথ্যসূএ: ইন্টারনেট