গেল বছর সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে ছয় হাজারের বেশি মানুষের জীবন। আহত হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। সব মিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গেল বছর তছনছ করে দিয়েছে প্রায় ২২ হাজার পরিবারকে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪৩১২টি। এতে নিহত হয় ৬ হাজার ৫৫ জন। আহত হয় ১৫ হাজার ৯১৪ জন। এর মধ্যে হাত-পা বা অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে ৯২৩ জন। এর আগের বছর ২০১৫ সালে সারা দেশে ৬৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয় ৮৬৪২ জন। আহত হয় ২১ হাজার ৮৫৫ জন। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে দুর্ঘটনা কমেছে ৩৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। নিহতের সংখ্যা কমেছে ২৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আহতের সংখ্যা কমেছে ২৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালে ১০৬৩টি বাস, ১১৮৭টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ৫৯৭টি হিউম্যান হলার, ৬৪৯টি কার, জিপ, মাইক্রোবাস, ৯৭৩টি অটোরিকশা, ১৪৮৯টি মোটরসাইকেল, ১১৯০টি ব্যাটারিচালিত রিকশা, ৮৬৩টি নসিমন করিমন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এতে ৮০৩ জন ছাত্রছাত্রী, ২৩৩ জন শিক্ষক, ৬১ জন সাংবাদিক, ৬৩ জন ডাক্তার, ৫২ জন আইনজীবী, ৭৫ জন প্রকৌশলী, ৪৩৮ জন শ্রমিক, ২৯৪ জন চালক, ২৩৫ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (পুলিশ, সেনাসদস্য, বিজিবি ও আনসার সদস্য) দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এছাড়া, দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন ৪৩৩ জন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ১৫৯৮ জন পথচারী, ১৮২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ৮৪৩ জন নারী ও ৫৯৭ জন শিশু। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে সারা দেশে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৯৪টি। এতে মারা গেছে ২৩৭৬ জন। আহত হয়েছেন ১৯৫৮ জন। ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪৮৯টি। মারা গেছেন ১৪২২ জন এবং আহত হয়েছেন ১২৮৯ জন। পুলিশের কাছ থেকে দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। তাদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৯৪টি। এতে মারা গেছেন ২৩৭৬ জন এবং আহত হয়েছেন ১৯৫৮ জন। ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ২১৭৫টি। এতে মারা গেছেন ২০৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ১৮৩৮ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, একটি সড়ক দুর্ঘটনা শুধু দুর্ঘটনাই না। দুর্ঘটনায় মারা যায় গাড়ির চালক, যাত্রী ও পথচারী। তবে তছনছ করে দিয়ে যায় পুরো পরিবার ও সমাজকে। দুর্ঘটনার পর যিনি পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকেন তিনি পরিবার এবং অনেক সময় সমাজেরও বোঝা হয়ে বেঁচে থাকেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় পরিবারটি। আবার দুর্ঘটনার পর চিকিৎসা করাতে গিয়ে তছনছ হয়ে যায় পরিবার। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ মানবজমিনকে বলেন, একজন স্বাভাবিক ভাবে আঘাত পেয়ে ভেঙে গেলে যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুর্ঘটনায় ভেঙে গেলে। দুর্ঘটনা হয় সাধারণত রাস্তায়। রাস্তায় দুর্ঘটনার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে পড়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় রাতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। সকালে মানুষ জানতে পেরেছে তখন তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। এই সময়টাতে ভুক্তভোগীর অনেক ইনজুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, যাত্রী, চালক ও জনসাধারণের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে দুর্ঘটনা কমানো যেতো। এছাড়া, পর্যাপ্ত সংখ্যক ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ও গতি নিরোধক নির্মাণ করেও দুর্ঘটনা কিছুটা কমানো সম্ভব। সাধারণত চালকের বেপরোয়াগতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি ও যাত্রীদের অসতর্কতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.