বাংলাদেশে আমরা ভালো ছিলাম। এখানে ভালো নেই। কিছু না হলে ফের বাংলাদেশে আগের ছিটমহলে ফিরে যেতে চাই।’ সংবাদমাধ্যমের কাছে এভাবেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ছিটমহল থেকে থেকে ভারতে চলে যাওয়া অনেকেই।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া সন্তরাম রায়, মায়া রানী রায়, গোলাপ রায়, হরি রায়, ভূপেন রায়, জয়প্রকাশ বর্মণ জানান, বাংলাদেশের ছিট থেকে ভারতে গিয়েছিলেন দুবেলা দুমুঠো খেয়ে শান্তিতে থাকবেন বলে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজও বাস্তব হয়নি। ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে ভোট দিলেও নাগরিকের সব সুবিধা থেকে আজও তাঁরা বঞ্চিত। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ছিট থেকে নাগরিক হওয়া ব্যক্তিদের জন্য কোটি টাকা খরচ করলেও তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে নেই পর্যাপ্ত খাবার, বাসস্থান এবং যথেষ্ট পরিষেবা।
কোচবিহারের হলদিবাড়ির ‘এনক্লেভ ক্যাম্পে’ আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দারা বলেন, অনেক আশা নিয়ে বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে তাঁরা ভারতে গিয়েছিলেন। ভারতে গিয়ে তাঁদের ভোট দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু জীবনযাত্রার অন্ধকার কাটেনি। গত বছরের নভেম্বর থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে রয়েছেন তাঁরা। ভারতে গিয়ে পর্যাপ্ত ভাত জুটছে না তাঁদের। চাল, ডাল, তেল, নুন পর্যাপ্ত পরিমাণে দিচ্ছে না সরকার। খিদে মেটাতে অগত্যা কচুশাক খেতে হচ্ছে। অনেক বাসিন্দা বলেন, ১০০ দিনের কাজ করেও তারা এখনো টাকা হাতে পাননি। কীভাবে বেঁচে থাকবেন তাঁরা?
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া বাসিন্দাদের কয়েকজনের বক্তব্য, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু না কিছু কাজ করতাম আমরা। সেখানে হিংসা থেকে বাঁচতে শান্তির খোঁজে ভারতে গেলাম। কিন্তু এখানে যে দিন কাটানোই মুশকিল।’ তাঁদের অভিযোগ, ‘ভারতে যাওয়ার সময় সরকার আমাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিল। ভেবেছিলাম সুদিন ফিরবে কপালে। কিন্তু আজ বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ পাচ্ছি না আমরা। সরকার থেকে ৩০ কেজি চাল, পাঁচ কেজি করে ডাল ও তেল এবং দুই কেজি লবণ দেওয়া হলেও বড় পরিবারের জন্য সারা মাসের খাবার জোটে না।’ বয়স্ক বাসিন্দাদের অনেকেই আজ অনুতাপ করছেন, জীবনের শেষ বেলায় এসে একি বিপদে পড়লাম!
শুধু খাবারদাবারই নয়, স্বাস্থ্য পরিসেবার ক্ষেত্রেও সাবেক ছিটবাসীদের চূড়ান্ত গাফিলতির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হলদিবাড়ি এনক্লেভ সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিদিন সেই পরিষেবা পাওয়া যায় না। স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য হলদিবাড়ি হাসপাতালের লাল ও বড়িই একমাত্র ভরসা।
উল্লিখিত সব কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া ৯২২ জন বাসিন্দার অধিকাংশের মনেই এখন ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। ভারতে গিয়ে ছোট টিনের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। রাস্তার ওপরই চলছে শিশুদের গোসল। বৃদ্ধ হয়েও কলসিতে করে পানি বহন করতে হয়। আর পেটের তাগিদে খেতে হয় কচুশাক। এভাবেই কাটছে তাঁদের দিন-রাত।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের ভূমিকা পালন করলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তার ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফলে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ছিটের বাসিন্দারা আজ অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এমন অবস্থায় অনেকেই চাইছে ফের বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে যেতে। তাঁদের মধ্যে অনেকে হয়তো বাংলাদেশে ফিরেও যাবেন। তিনি আরো বলেন, এই বাসিন্দারা যুদ্ধ-বিধবস্ত এলাকা থেকে যায়নি। তাঁরা সামান্য সুখ স্বাচ্ছ্যন্দের লোভে ভারতে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে গিয়ে ন্যূনতম সুবিধা না পেলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ফের বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাইবেন। এই চাওয়াটাই তো বাস্তব।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.