ঐতিহাসিক ও আধুনিক শহর ভারতের গোয়ালিয়র। কথিত সাধু গৃবালিপার নাম থেকে শহরের নাম হয়েছে গবালিয়র। আরেক মত গোয়ালা থেকে গোয়ালিয়র নাম। ব্রিটিশের মুখে মুখে হয়েছে গোয়ালিয়র। দুর্গই মূল আকর্ষণ গোয়ালিয়রের। কাছাওয়া রাজাদের হাতে গোয়ালিয়রের বাড়বাড়ন্ত। কাছাওয়া থেকে পরিহরদের দখলে যাওয়ার পরে ইলতুতমিস পরিহরদের হঠিয়ে গোয়ালিয়র দখল করেন। তোমাররাজ মান সিংয়ের সময় সুবর্ণ যুগ আসে গোয়ালিয়রে। শেরশাহও আসেন গোয়ালিয়রে। গোয়ালিয়রে পরিহর, কাছাওয়া ও তোমার রাজারা রাজত্ব করে গেছেন। তাদের কীর্তিকলাপ তথা প্রাসাদ, মন্দির, নানান সৌধ গোয়ালিয়রের মুখ্য দ্রষ্টব্য।
মোগল সাম্রাজ্যের স্থপতি বাবরের মতে হিন্দুস্থানের উজ্জ্বল রত্ন গোয়ালিয়র দুর্গ। কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত সামন্তরাজা সূর্য সেন রোগমুক্ত হন সাধু গবালিপার মন্ত্রপূত সূর্য কুণ্ডের জলে। রোগমুক্তির পর নামেরও বদল ঘটান। সূর্য সেন হন সূর্য পাল, আর কুণ্ডর নাম হয় সুর্যকুণ্ড। সাধুরই ভবিষ্যদ্বাণী এই পাল রাজারা অজেয় থেকে রাজত্ব করবে গোয়ালিয়রে। সাধুর ইচ্ছায় গোপাচল পাহাড়ে গোয়ালিয়র দুর্গ গড়েন সূর্য পাল। আরও পরে মোগল সম্রাট বাবর জয় করে নেন এই দুর্গ। আর ১৭৫৪-এ মোগলদের পতনের পর সিন্ধিয়া (মারাঠা) রাজাদের হাতে যায় গোয়ালিয়র। স্বাধীনতা উত্তরকালেও ভারতীয় রাজনীতিতে সিন্ধিয়া রাজবংশ খুবই সক্রিয় ছিল।
শহর থেকেও ৯১ মি. অধিক উচ্চে ৯ মি. উঁচু প্রাচীর ঘেরা ২.৮ কিমি. দীর্ঘ এবং ২০০ থেকে ৮০০ মি. প্রস্থের বেলেপাথরের খাড়া পাহাড়ে গোয়ালিয়র দুর্গ। সোমবার ছাড়া সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শন করা যায়। প্রতিরক্ষার দিক থেকে খুবই সুরক্ষিত ছিল এই দুর্গ। দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে দুটি পথে দুর্গে প্রবেশ করা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিমের পথে ৭-১৫ শতকের মধ্যে পাহাড় কেটে তৈরি ২২ জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি, রঙ-বেরঙের দেওয়াল চিত্রে জৈন মিথোলজি আকর্ষণ বাড়িয়েছে। ছটি শিলালিপির সঙ্গে এখানে মহাবীরের পিতা-মাতার মূর্তিও হয়েছে। পশ্চিমে গেটের কাছে পদ্মের ওপর দণ্ডায়মান ১৯টি উচ্চ ১৫ শতকের মূর্তি। তার মধ্যে ২০তম তীর্থঙ্কর আদিনাথ ও ১০ মি. উঁচু উপবিষ্ট ২২তম তীর্থঙ্কর নেমিনাথের মূর্তি দুটি অনবদ্য। দৈবজ্ঞানে পুজো করে ভক্তের দল। এ ছাড়া জীবজন্তু, স্বর্গের অপ্সরা মূর্ত হয়েছে দেওয়ালে। আর উত্তর-পূর্বে আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম হয়ে ১ কিমি. দীর্ঘ বন্ধুর পথ উঠেছে দুর্গের পাঁচটি গেট বা মহল পেরিয়ে দুর্গ। প্রথমটি ১৬৬০-এ ঔরঙ্গজেবের সম্মানে তৈরি আলমগীর গেট, দ্বিতীয়টি সমকালে তৈরি বাদলগড় বাদল সিংয়ের নামে নাম, তৃতীয়টি বানসুর বা আরচেরি গেট যা আজ লুপ্ত, চতুর্থ ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি গণেশ গেটের আকর্ষণ বহুবিধ। কবুতরখানা, সাধু গবালিপার ছোট মন্দির যেতে ৮৭৬-এ তৈরি চতুর্ভুজ বিষ্ণু মন্দিরের অবস্থান গণেশ গেটে। পঞ্চমটি ১৫১৬-এ মান সিংয়ের তৈরি হস্তী গেট। সেকালে রাজ পরিবারের যাতায়াতও ছিল হাতির পিঠে। হাতি চলে আজও যাত্রী নিয়ে এ পথে।
প্রেমের সৌধ : গোয়ালিয়র গেট দিয়ে দুর্গে ঢুকতেই বেলেপাথরের মিনারওয়ালা প্রেমের সৌধ গুজরি মহল। গুর্জর বংশীয় প্রিয়তমা মহিষী মৃগনয়নীর জন্য ১৫১০-এ মান সিংয়ের তৈরি স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সুন্দর। এ দুর্গের স্তম্ভের হলদে, সবুজ, নীলাভ রঙের সঙ্গে সোনালিতে বর্ণালি বেড়েছে। হাতি-মানুষ-হাঁস-তোতা-টিয়া-ফুল ও ফলের অলঙ্করণে। হস্তী গেট পেরোতেই কন্দধর্মী ৬ গম্বুজ শিরে মান সিং প্যালেস। এটিও তৈরি করেন মান সিং আর সংস্কার হয় ১৮৮১-তে। ডান্সিং হল ঘিরে ব্যালকনি-অঙ্গন। রঙ-বেরঙের টালি বসিয়ে জলসাগরের নানান নকশা ও পাথরের জাফরির কাজ অতুলনীয়। জনশ্রুতি, জাফরির অন্তরাল থেকে রানীরা গানের তালিম নিতেন। ছয় তলা প্রাসাদের দুটি তলা মাটির নিচে। সেখানে মান সিংয়ের গ্রীষ্মাবাস ছিল। আর ছিল ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাকক্ষ, ফাঁসিঘর, স্নানঘর। আওরঙ্গজেব, ভাই মুরাদকে বন্দি রেখে ডিসেম্বরে এখানেই হত্যা করেন। মাটির নিচের মহল দর্শনে দর্শনার্থীদের টর্চ সঙ্গে নেয়া ভালো। লাগোয়া বিক্রমাদিত্য প্যালেস মান সিংয়ের ছেলের নামে নাম। জনশ্রুতি আছে, কোহিনূর (হীরে) এখান থেকেই ভেট হিসেবে যায় হুমায়ুনের কাছে। অদূরে রাজা করণ সিংয়ের তৈরি দ্বিতল করণ মন্দির। কীর্তি মন্দির নামেও সমধিক খ্যাত। বিপরীতে ৮০ পিলারের কুণ্ড বা বাউড়ি। পরাজয়ের পর আব্রু বাঁচাতে যেখানে জহর করতেন রানীরা। ইলতুতমিসের দুর্গ দখলে এখানেই অনুষ্ঠিত হয় জহর। হিন্দুর দুর্গে মুসলিম প্রাসাদ জাহাঙ্গীর মহল ও শাহজাহান মহলও হয়েছে মান মন্দিরের পেছনে।
শাশুড়ি-বউমার মন্দির : অদূরেই পুব দেয়ালে শাস আর বহু অর্থাৎ। শাশুড়ি ও বধূর পৃথক পৃথক মন্দির। জৈন বলে দ্বিমত থাকলেও আসলে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর মন্দির। ১০৯৩-এ রাজা মহীপালের তৈরি মন্দিরে দেবতার অবর্তমান হলেও কারুকার্য আজও দেখে নেয়া যায়। প্রবেশদ্বারের ওপরে বিষ্ণুর মূর্তিও রয়েছে। মন্দির সংলগ্ন চাতাল থেকে শহরও দৃশ্যমান। আর দুর্গের পশ্চিমে রয়েছে দ্রাবিড় ও আর্য স্থাপত্যে গড়া দুর্গের প্রাচীনতম তেলিদের তেলি-কা-মন্দির। বিষ্ণু উপাস্য দেবতা। ছাদটি দ্রাবিড়ীয় শৈলীতে অলঙ্কৃত, আর দেয়াল আর্য ভাস্কর্যের নিদর্শন। উপরে ৩৩ মিটার উঁচু গম্বুজ। দুর্গের মধ্যে উচ্চতম এই বিষ্ণু মন্দির। বিপরীতে ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দর স্মারকরূপে গড়া গুরুদ্বারে দাতা বন্দি ছোড় পবিত্র শিখ তীর্থ। মর্মরের গুরুদ্বারের শিরে সোনার পাতে মোড়া গম্বুজ। গুরুদ্বারার পশ্চিমে সূর্যকুণ্ড। আরো পশ্চিমে সিন্ধিয়া স্কুল। আর রয়েছে গবালিপার মূর্তি, মসজিদ, ম্যাগাজিন, একখাম্বা তাল, রানী তাল, ছেদি তাল ছাড়াও নানান কিছু।
ঝিলমিল শিল্পের টানে : দুর্গের উত্তর-র্পূবে গোয়ালিয়র গেটের অনতিদূরে ধূলি-ধূসরিত ঘিঞ্জি পুরনো শহরে মোগলি স্থাপত্যে গড়া সংতীতজ্ঞ তানসেনের এবং বাবরকে সহায়তাকারী আফগান প্রিন্স তথা ফকির মহম্মদ ঘাউসের মকবরার পর্যটক আকর্ষণ কম নয়। চারপাশে ষড়ভুজ টাওয়ার মাঝে গম্বুজ। জাফরি অর্থাৎ। গোয়ালিয়রের ঝিলমিলি শিল্পেরও অপূর্ব নিদর্শন মেলে তানসেন ও মহম্মদ ঘাউসের মকবরায়। শহরের উত্তরে বেলেপাথরের মহম্মদ খানের তৈরি জামে মসজিদটিও চলতে ফিরতে দেখে নেয়া যায়। রেল স্টেশনের কাছে লস্কারে মোতি মহলের বিপরীতে রয়েছে মিউনিসিপ্যাল মিউজিয়াম। মুঘল, রাজপুত আর মারাঠা মুদ্রার উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ এখানে রয়েছে।
জয় বিলাস : নতুন শহরে সিন্ধিয়া রাজপরিবারের বসতবাড়ি জয় বিলাস প্রাসাদ। প্রিন্স অব ওয়েলসের আগমনে ১৮৭২-’৭৪-এ ইতালিয়ান অনুকরণে ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে জিয়াজি রাও সিন্ধিয়ার তৈরি। বাসও করছেন রাজপরিবার বার্কিংহাম প্রাসাদের অনুকরণে তৈরি জয়বিলাস প্রাসাদের অংশে। তেমনই, রাও পরিবারের বিলাস-ব্যসন দেখে নেয়া যায় জয়বিলাসে। ৩৫ কক্ষ নিয়ে গড়া সিন্ধিয়া মিউজিয়াম। বেলজিয়াম কাট-গ্লাসের নানান সম্ভার, বিষ পরীক্ষার প্লেট, ফ্রান্স ও ইতালীয় আসবাবপত্র, ইতালি থেকে আনা শ্রীকৃষ্ণের কাচের দোলনা, চিঙ্কুরানীর নানা সম্ভার, দোলনা-চেয়ার, অতিথি আপ্যায়নে ব্যাটারিচালিত রুপার টয়ট্রেন, শিকার করা স্টাফড জীবজন্তু, ঔরঙ্গজেব ও শাহজাহানের তরবারি, দরবার হলে ৫০০ কেজি সোনায় রঞ্জিত বিশ্বের দুই বৃহত্তম ঝাড়লণ্ঠন। সাড়ে তিন টনের ১৩ মিটার উঁচু ঝাড়লণ্ঠনে ২৪৮টি মোমবাতি একত্রে জ্বলে। ঘোড়াশালায় ফিটনগাড়ির রকমফেরও উল্লেখ্য। মবার ও ছুটির দিন ছাড়া সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা, টিকিট ২৫ টাকা৷
কীভাবে যাবেন : প্রথমে চলে যাবেন হাওড়া। এখান থেকে ছেড়ে ১২১৭৭ এবং ১২১৭৫ চম্বল এক্সপ্রেস আসানসোল, ধানবাদ, গয়া, এলাহাবাদ, মানিকপুর, ঝাঁসি হয়ে গোয়ালিয়র যায়। এ ছাড়া পুরী নিজামুদ্দিন কলিঙ্গ এক্সপ্রেস প্রতিদিন পুরী ছেড়ে খড়গপুর হয়ে টাটা, রাউরকেল্লা, বিলাসপুর, কাটনি ঝাঁসি হয়ে গোয়ালিয়র যায়। শহরে চলে অটো, টেম্পো, ট্যাক্সি ও মিনিবাস। তবে মিটার নয়, চুক্তিতে চলতে আগ্রহী ট্যাক্সি ও অটোগুলো।
কোথায় থাকবেন : গোয়ালিয়রে থাকার জন্য সরকারি ও বেসরকারি অজস্র হোটেল রয়েছে৷ আছে এমপিটিডিসির হোটেল তানসেন রেসিডেন্সি৷
তথ্যসূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.