বাংলা চলচ্চিত্রে গ্রামীণ চরিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘মিয়াভাই’ হিসেবে পরিচিত অভিনেতার নাম ফারুক। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এইচ আকবার তাঁর পরিচালনায় ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে তাকে নায়ক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেন। প্রথম ছবিতেই ফারুকের মধ্যে প্রতিবাদী চরিত্রের ছায়া খুঁজে পান খান আতাউর রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন, নারায়ণ ঘোষ মিতা এবং আমজাদ হোসেনের মতো বিখ্যাত পরিচালকরা। কবরী, শাবানা, ববিতা, রোজিনা, অঞ্জনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, চম্পা, রানীসহ ৭০-৮০-এর দশকের প্রায় সব নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করলেও জুটি হিসেবে ববিতা-ফারুক ছিল দর্শকদের সবচেয়ে পছন্দের। তখনকার সময়কে বলা হয় চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ।
চলচ্চিত্রের সেই যুগ নিয়ে নায়ক ফারুক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আসলে কিছুই এমনিতেই সোনা হয়ে যায় না। আমাদের ওই সময়টাতে এর জন্য অনেক প্রচেষ্টাও ছিল, প্রতিযোগিতা ছিল। একটা ঘটনা বললেই বোঝাতে পারবে। ধরুন যে নায়ক উজ্জ্বলের একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। তখন আমি তিনটি সিনেমা হলে তিন লোক পাঠিয়ে দিলাম। তারা একটু পরপর আমাকে খবর দিচ্ছে কেমন দেখছে দর্শক। খবর পেলাম ভালো চলছে, দর্শক ছবিটি পছন্দ করেছে। তখন আরেকজন লোক পাঠালাম সারা ছবিতে কতগুলো হাততালি দিল সেটা দেখার জন্য। কোন কোন জায়গাতে দর্শক উত্তেজিত হচ্ছে, কোন সময় দর্শক আনন্দ প্রকাশ করছে। পুরো হিসাবটি নিয়ে আমি সিনেমা হলে গেলাম ছবিটি কেন দর্শক এত ভালোভাবে গ্রহণ করছে সেটা দেখার জন্য। নায়কের অভিনয় এবং দর্শক উত্তেজনার যোগসূত্র অনুমান করার চেষ্টা করতাম। তারপর নিজের ছবিতে সেটা ফলাতে চেষ্টা করতাম। আবার কোনো জায়গাতে যদি কেউ খারাপ করত, সেটা আমরা একে ওপরকে বুঝিয়ে দিতাম। আমাদের মাঝে প্রতিযোগিতা ছিল কিন্তু সেটা অনেকটা পজেটিভ। আমরা সবাই ভালো করতে চেষ্টা করতাম এবং অন্যকে ভালো করতে সহযোগিতা করতাম। আমরা ছিলাম একটি পরিবার।’
বর্তমানে ছবিতে কীসের অভাব মনে হয় জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘এখন কেউ মন দিয়ে কাজটি করতে চায় না। কিছুদিন আগে আমি একটি গ্রামের ছবি দেখলাম। সেখানে দেখলাম নায়কের কানে দুল, গায়ে দামি ব্র্যান্ডের শার্ট। এখন বিষয় হচ্ছে গল্পে একটা মানুষ কেমন করে প্রবেশ করবে। সিনেমার গল্পে ছেলেটি যদি শহর থেকে ঘুরে যেত তা হলে তার গায়ে ব্র্যান্ডের শার্ট বা কানে দুল থাকতে পারে। একটি অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে কেমন হয়, তার ড্রেসআপ গেটআপ কেমন হয়, গল্পটা কোন অঞ্চলের, তাদের চলাফেরা কেমন, এই বিষয়গুলো নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে একজন শিল্পীকে। নিজেকে শুধু নায়ক ভেবে সুন্দর মেকাপ নিয়ে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে হবে না।’
বর্তমান সময়ের নির্মাতাদের নিয়ে ফারুক বলেন, ‘আমার মনে হয় ভালো গুণগতমান সম্পন্ন পরিচালকের অভাব হয়েছে। কারণ নায়ক কী পড়বে, কীভাবে চলাফেরা করবে সেটা যদি ঠিক না থাকে তবে পরিচালক বুঝিয়ে দেবে বা গল্পের জন্য নায়ককে তৈরি করে নেবে। সেটা তো হচ্ছে না। যে যার মতো কাজ করছে, ভালো কিছু হচ্ছে না, দর্শকও দেখছে না।’
আপনি কেন এখন অভিনয় করছেন না জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘কীসের অভিনয় করব? কেউ একজন বাবার চরিত্র নিয়ে এলেন, কাজের জন্য গিয়ে দেখি কিছুই ঠিক নেই। চরিত্রের কোনো গভীরতা নেই। শুধু বাবার চরিত্রে কাজ করার মতো অনেক অভিনেতা বসে আছেন। আমাকে কেন সাধারণ বাবার চরিত্র করতে হবে? শুধু আমি নই নায়করাজ এখনো বেঁচে আছেন এবং সারা দেশের মানুষ তাঁকে অনেক পছন্দ করেন। তাঁকেও তো কেউ সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন না। আসলে যাঁরা কাজ করছেন, পরিচালনা করছেন, চিত্রনাট্য লিখছেন—তাঁদের প্রতি আমি হতাশ।’
হতাশা প্রকাশ করে ফারুক আরো বলেন, ‘আমাদের পরিচালনার জন্য যে মনন ও মেধা দরকার আমাদের ঢাকার বর্তমান চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে অনেকেরই সে মেধা নেই। তাঁরা ছবির ওপর পড়াশোনা না করেই প্রযোজক হয়ে নেমে পড়েন সিনেমা তৈরি করতে। তাঁরা ক্যামেরা, লেন্স, সিকোয়েন্স না বুঝেই যখন তখন যেকোনো স্পটে শুটিং শুরু করে দেন। ছবি পরিচালনার জন্য আপনাকে ব্যাপক পড়াশোনা করতে হবে। তা ছাড়া আপনি কাজে সফলতা আনতে পারবেন না।’
যে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান শুরু হয়, সেই ১৯৭৫ সালেই শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতা ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফারুক, ছবির নাম ছিল ‘লাঠিয়াল’। ‘নয়নমণি’, ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও প্রশংসিত হয়েছেন তিনি, পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। ফারুক বলেন, ‘আমি কয়টা পুরস্কার পেলাম সেটা বিষয় নয়। আমি সাধারণ মানুষের মন থেকে যে পুরস্কার পেয়েছি, তারপর আর কিছুই পাওয়ার নেই।’
চলচ্চিত্র অভিনেতা থেকে চলচ্চিত্র প্রদর্শক এবং প্রযোজক হলেও বর্তমানে ফারুক চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছেন। ঘোড়াশালে তাঁর মালিকানাধীন প্রেক্ষাগৃহ ‘জলসা’ লোকসানের সম্মুখীন হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্তমানে কালিয়াকৈরে রয়েছে তাঁর টেক্সটাইল মিল। বর্তমানে ফারুক আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। ফারুক ও স্ত্রী ফারহানা পাঠানের দুই সন্তান। কন্যা ফারিহা তাবাসসুম পাঠান এবং পুত্র রওশন হোসেন পাঠান বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.