২ হাজার ১৬৭ দিন পর হার মানল আমলাতন্ত্র। জিতলেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কানাডার এই নাগরিক বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে নিজের গাড়ি নিয়ে ২০১০ সালের মে মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন। পাকিস্তান সফর শেষে তিনি করাচি বন্দরে জাহাজে তুলে দেন তাঁর গাড়িটি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়িটি বের করতে তাঁর সময় লাগল প্রায় ছয় বছর। বছরের পর বছর এই দপ্তর থেকে ওই দপ্তর, এই মন্ত্রণালয় থেকে ওই মন্ত্রণালয়ে ছুটতে হয়েছে আবদুস সাত্তারকে। ততদিনে বিশ্বভ্রমণের বিষয়টি শিকেয় উঠেছে। জেদ চাপে তাঁর, গাড়ি না নিয়ে তিনি ফিরবেন না। এই ছয় বছরে একবারের জন্যও কানাডায় যাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে তাঁর। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ঘুচিয়ে ৪ মে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়িটি খালাস করতে পেরেছেন তিনি। এই গাড়ি নিয়ে অসমাপ্ত বিশ্বভ্রমণ আবারও শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ৫৭ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া এই মুক্তিযোদ্ধার বয়স এখন ৬৩। মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়ি নিয়ে ২০০৯ সালে আবদুস সাত্তার যখন বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়েন, তখন তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয়, নাম স্যাল বয়। তবে এখানে এসে ‘ধৈর্যহারা’ হয়ে তিনি কিছুদিন পর ফিরে যান কানাডায়। গাড়িটি এখন চট্টগ্রাম নগরের চৌমুহনী এলাকার একটি গ্যারেজে মেরামত চলছে। আবদুস সাত্তার বলেন, টানা ছয় বছর এটি চট্টগ্রাম বন্দরের একটি কনটেইনারের ভেতরে পড়ে থাকায় মরিচা ধরেছে। অনেক যন্ত্রাংশ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। পেশায় হিসাবরক্ষক আবদুস সাত্তার কানাডার টরন্টো শহর থেকে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট যাত্রা শুরু করেন। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড, তারপর ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ ঘুরে তুরস্কে যান। তারপর ইরান ও পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ। এরপর আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় তাঁর লড়াই। আবদুস সাত্তার বলেন, প্রথমে গাড়ি ছাড় করাতে তিনি যান কমলাপুর আইসিডির শুল্ক কর্মকর্তার দপ্তরে। এরপর শুল্ক বিভাগ তাঁকে ৯৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে বলেন। এত টাকার কথা শুনে বিস্মিত হন তিনি। গত প্রায় ছয় বছরে গাড়িটি ছাড়াতে তিনি অর্থ, বাণিজ্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গেছেন কমপক্ষে ৭৮ বার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যালয় তাঁর ঘোরা হয়েছে ৮২ বার। কমলাপুর আইসিডিতে ৮ বার, চট্টগ্রাম কাস্টমসে ২২ বার, চট্টগ্রাম বন্দরে ১২ বার এবং ঢাকার বিভিন্ন দপ্তরে ১০০ বার তাঁকে ঘুরতে হয়েছে। কোন দপ্তরে কতবার গেছেন, তা লিখে রেখেছেন তিনি। গাড়ি ফিরে পাওয়ার এই দীর্ঘ বিড়ম্বনা নিয়ে বই লেখারও ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। গত ছয় বছরের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আবদুস সাত্তার কৃতজ্ঞতা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রতি। অর্থমন্ত্রীর প্রচেষ্টাতেই ২ হাজার ১৬৭ দিন পর তিনি গাড়িটি পেয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, প্রথম আলো এবং আরও কয়েকটি পত্রিকা তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত বছর একটি পত্রিকার কাটিংয়ের ওপর অর্থমন্ত্রী তাঁর অধীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে লেখেন, ‘এই ভদ্রলোককে খুঁজে বের করে আমার কাছে পাঠান।’ তিনি বলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এরপর আমলাতন্ত্রের সব জট উপেক্ষা করে মন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি গাড়িটি ফিরে পান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়িটি ছয় বছর পড়ে থাকায় সব মিলিয়ে ভাড়া এসেছে ৪৩ লাখ টাকা। তবে অর্থমন্ত্রীর কারণে সব ভাড়া মওকুফ করে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের পর্ষদ সদস্য জাফর আলম বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে বন্দর থেকে কোনো পণ্য বের হওয়ার সুযোগ নেই বলে গাড়িটি ছয় বছর বন্দরে আটকে ছিল। অর্থমন্ত্রীর বিশেষ সুপারিশে ৪ মে গাড়িটি ছাড়া হয়েছে। আবদুস সাত্তার বলেন, বন্দর থেকে খালাসের পর গাড়িটি মেরামতের জন্য ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে এনবিআর। এরপর আরও পাঁচ দিন দেশে থাকা যাবে। তারপর গাড়িটি নিয়ে তাঁকে চলে যেতে হবে। চট্টগ্রাম নগরের চৌমুহনী এলাকার যে গ্যারেজে গাড়িটি মেরামত করা হচ্ছে, সেই গ্যারেজের মালিক আবদুস সবুর বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর কনটেইনারে আটকে থাকায় গাড়ির কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে, যা দেশে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে মেরামত করতে আরও সময় লাগবে। গাড়িটির মেরামতকাজ শেষ হলে আবদুস সাত্তার ঢাকা হয়ে ভারতে যাবেন। এরপর তিনি গাড়িটি চালিয়ে নেপাল, ভুটান, চীন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যাবেন। এভাবে চলতে থাকবে তাঁর বিশ্বভ্রমণ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.