দেশে অবৈধভাবে দুই লাখের বেশি বিদেশী নাগরিক রয়েছেন যাদের বেশিরভাগই ভারতের। এর পরের ধাপে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক।
কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই এরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। এভাবে তারা উপার্জিত অর্থের বড় অংশ নির্বিঘ্নে নিজ দেশে পাঠাচ্ছেন যার পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকা।
অপরদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য বলছে, শুধু ভারতেরই পাঁচ লাখ নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন যারা ২০১৫ সালেই তাদের দেশে নিয়ে গেছেন ৩০ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগজনক তথ্য হিসেবে দেখছেন। অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও এসব বিদেশীরা দেশের আইনশৃংখলার জন্য চরম হুমকি।
এদিকে বিদেশীদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কোনো দফতরের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এমনকি এখানে অবৈধভাবে কত সংখ্যক লোক বসবাস করছেন তার সঠিক হিসাব বের করতে তেমন কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন এমন বিদেশীদের একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এর আগে একটি তালিকা থাকলেও সে তালিকা অনুযায়ী অবৈধ এসব বিদেশীদের বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এদের শনাক্ত করতে আইনশৃংখলা বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মাঝে-মধ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদেশীদের কাজের অনুমতি দেয়া হয়। এগুলো হল- বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) এবং এনজিও ব্যুরো। এ তিন প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, বৈধভাবে মাত্র সাড়ে ১৬ হাজার বিদেশী দেশে কাজ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের সংখ্যা ২ লাখের কিছু বেশি। প্রতিবছর এরা ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, দেশে বিদেশীর সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার। এ হিসাবে তিন প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া যেসব বিদেশী কাজ করছেন, তারা সবাই অবৈধ।
অর্থনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিদেশী বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও তারা পাচার করছেন বলে অভিযোগ আছে। এজন্য নিরাপত্তার প্রশ্নে এদের ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিদেশীদের অবৈধভাবে থাকার বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। এর আগেও বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছিল।
তিনি মনে করেন, অবৈধভাবে কোনো বিদেশী কাজ করবেন, এটি কোনো দেশই এখন আর মেনে নেয় না। কেননা, এতে করে প্রথমত দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ অনুমতি ছাড়া কাজ করার মানে হল, তারা যে পরিমাণ অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন, তার পুরোটাই অবৈধ। দ্বিতীয়ত, বিষয়টির সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, এসব অবৈধ বিদেশী জঙ্গি হামলাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিদেশে পাচার করছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে। এ দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এটি অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় এবং দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। মাঝে-মধ্যে সীমান্ত অতিক্রমের সময় অনেক বিদেশী ধরা পড়ছেন। এদের অনেকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কঠোর মনিটরিং ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নেই বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশীদের পরিসংখ্যান নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য আরও ভয়াবহ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য বলছে, শুধু ভারতেরই পাঁচ লাখ নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন।
২০১৫ সালে তারা ৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন অর্থ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমনকি ভারতের রেমিটেন্স আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ রয়েছে পঞ্চম অবস্থানে। প্রথম অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
২৫ জুন জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বর্তমানে দেশে বৈধভাবে এক লাখ ১১ হাজার ৫৭৫ জন বিদেশী নাগরিক রয়েছেন। এর মধ্যে ২০ হাজার ৬৫৬ জন ভারতীয়। আর মোট ৯১০ জন বিদেশী নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে।
সূত্র বলছে, এসব অবৈধ বিদেশী বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন। দেশের বহুল আলোচিত ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এর আগেও জাল টাকা তৈরির অপরাধে শ্রীলংকার কয়েকজন নাগরিককে আটক করা হয়।
জানা গেছে, বিনিয়োগ বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে বর্তমানে ১৪ হাজার বিদেশী কাজ করছেন। আর বেপজার অনুমতি নিয়ে ২ হাজার এবং এনজিও ব্যুরো থেকে অনুমতি নিয়ে আরও ৫শ’ বিদেশী নাগরিক কাজ করছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশে বিদেশী জনশক্তির সংখ্যা ২ লাখ। বিদায়ী ২০১৫ সালে তারা ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে প্রায় ২টি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। এছাড়া এ পরিমাণ অর্থ দেশের মোট রেমিটেন্সের এক-তৃতীয়াংশ। এর অর্থ হল, প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, তার এক-তৃতীয়াংশই এভাবে আবার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত দক্ষতা উন্নয়ন: উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের অগ্রাধিকার শীর্ষক এক প্রকাশনায়ও এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বিনিয়োগের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, বিদেশী নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট নিতে হলে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। বিনিয়োগ বোর্ডে আবেদন করলে আমরা নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত নেই। মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক মতামত এলে প্রথমে এক বছরের জন্য কাজের অনুমতি দেয়া হয়। পরে আবেদন করলে নবায়ন করা হয়।
তিনি বলেন, ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কেউ কাজ করলে সেটা দেখার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। বিনিয়োগ বোর্ড থেকে বিষয়টি নজরদারি করা হয় না।
সূত্র মতে, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ৫৫টি দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশে কাজ করছেন। এরমধ্যে প্রথম অবস্থানে ভারত। এরপরেই রয়েছে শ্রীলংকা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, আফ্রিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। এরা গার্মেন্ট খাতে প্রডাকশন ম্যানেজার, মার্চেন্ডাইজার, কাটিং মাস্টার এবং ডিজাইনারের মতো শীর্ষ পদে কাজ করছেন।
এছাড়া বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউজ, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, নানা ধরনের পার্লার, এমনকি শোরুমের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করছেন।
এদিকে বিদেশীরা শুধু দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থানেই সংকট সৃষ্টি করছেন না, একই সঙ্গে তারা দেশের প্রচলিত আইন উপেক্ষা করে রাজস্বও ফাঁকি দিচ্ছেন। বর্তমান আইনে বিদেশীদের অর্জিত আয়ের ৩০ শতাংশ কর দেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে কাজ করার কারণে তারা কর দিচ্ছেন না।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে বাংলাদেশী কোনো প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশীদের নিয়োগ দিলে ওই কোম্পানির প্রদেয় আয়করের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বা কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এ বিধান কার্যকর হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.