চীনে অলিম্পিক ছাপিয়ে যে বিচ্ছেদ আলোচনায়

বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব কম ইস্যুতেই এত বেশি আলোচনা হয়। নিজের ওয়েবে (চীনা টুইটার) অ্যাকাউন্টে ওয়াং বাওকিয়াং লিখেন, ‘আমার এজেন্ট সং ঝে’র সঙ্গে মা রং-এর অনৈতিক বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক থাকায় আমার সংসার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণে আমি মা রং-এর সঙ্গে আমার সংসারের ইতি টানার এবং সং ঝে’কে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অল্প কিছুক্ষণ পর আরেক পোস্টে মা রং ইঙ্গিত দেন যে, ওয়াং তাদের সংসার পরিত্যাগ করেছে। তিনি সুনাম ক্ষুণ্নের অভিযোগে মামলা দায়েরের হুমকি দিয়ে ওয়াং-কে ওই পোস্ট মুছে দিতে বলেন। তবে তাতে কর্ণপাত করেননি ওয়াং। আদালতের কাছে করা এক আবেদনে তাদের সংসারে জন্ম নেয়া দুই শিশুর দায়িত্ব চেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি তাদের খরচের জন্য মা রং-এর কাছ থেকে অর্থ দাবি করেছেন।
বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা দৃশ্যত ওয়াং বাওকিয়াং-এর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। #ওয়াং ডোন্টক্রাই (ওয়াং, কেঁদো না), #ওয়াং উই সাপোর্ট ইউ (ওয়াং, আমরা তোমাকে সমর্থন করি) নামে বহু হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনে। ওয়েবেতে এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘দরিদ্র্য অঞ্চল থেকে উঠে আসা কঠোর পরিশ্রমী পুরুষ ওয়াং। ওই মহিলা এক সৎ লোকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি এ ধরনের মানুষকে পছন্দ করি না।’
খবরে বলা হয়েছে, চীনা ওয়াং বাওয়াকিয়াং-এর নাম লোকের মুখে মুখে। হেবেই প্রদেশের একটি গ্রামে তার জন্ম। ছয় বছর বয়স থেকে তিনি মার্শাল আর্ট শেখা শুরু করেন। তিনি উচ্চ শিক্ষিত নন। কিন্তু বেইজিং-এর বিভিন্ন ছায়াছবি বা টিভিতে তিনি অল্পবিস্তর অভিনয়ের সুযোগ পান। সেখানে তাকে লাজুক, ভদ্র, দায়িত্বপরায়ণ ও উজ্জীবিত করার মতো মানুষ হিসেবে মূলত দেখানো হয়েছে। তবে ২০০৪ সালের আগে তাকে কেউ চিনতোই না বললেই চলে। ওই বছর ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড উইদাউট থিভস’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। সে তুলনায় তার স্ত্রী মা রং-এর খ্যাতি অত বেশি নয়। এমনকি ওয়াং বাওকিয়াং-এর সঙ্গে বিয়ের আগে তাকে অত বেশি চীনা চিনতো না।
কিন্তু এ বিয়ে নিয়ে এত আলোচনা কেন? ধারণা করা হচ্ছে, চীনে রাজনীতি নিয়ে কথা বলাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়। তাই তারকা দম্পত্তির বিয়ে নিয়েই কথা বলাটা সবাই নিরাপদ বোধ করছে। তবে এর আগে কোনো তারকার বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত আলোচনা হয়নি। তাহলে এবার কেন?
অনেক মানুষ মনে করছে, এ ডিভোর্সে আশ্চর্য্যজনিত হওয়ার কিছু নেই। সুন্দরী কিন্তু সাধারণ ঘরের মেয়ে ধনী কিন্তু কম সুদর্শন পুরুষকে বিয়ে করলে এমনটা হতেই পারে। তাদের বক্তব্য, যেকোনো  সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকতে হয়। সামাজিক মর্যাদা থেকে শুরু করে শারীরিক সৌন্দর্য- সব দিক থেকে উভয়ের মধ্যে সমতা থাকা চাই। এমনকি চীনের প্রাচীন এক ক্ল্যাসিক্যাল উপন্যাসে এ ধরনের অসম বিয়ের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। ওই উপন্যাসে দেখা যায়, পান জিনলিয়ান নামে এক সুন্দরী অর্থলোভী নারী বিয়ে করে উ দালাং নামে ধনী কিন্তু অনাকর্ষণীয় এক পুরুষকে। পরে তার সঙ্গে প্রতারণা করে পান জিলিয়ান আরেক পুরুষের কাছে চলে যায়। এমনকি উ দালাং-কে খুনও করে পান জিলিয়ান। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মু ঝেং বলেন, ‘সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়ের সবদিক থেকে ঠিকঠাক মিলে যাওয়ার ধারণা চীনে খুবই বিশ্বাস করা হয়। আবার আর্থ-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পুরুষকে বিয়ে করার চলও প্রচলন আছে নারীদের মধ্যে।’
ফলে অনেক মানুষ এ দিকটিই তুলে ধরছে। মানুষ বলাবলি করছে, অসম জুটিদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা আসলেই কি কম? ড. মু ঝেং বলেন, ‘এ গল্পের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, এক সাধারণ মেয়ে বিয়ে করেছে বিখ্যাত ও ধনী পুরুষকে। কিন্তু আরো ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে দেখা যাবে, এখানে পুরুষটি এসেছে দরিদ্র্য পরিবার থেকে। সে খুব শিক্ষিত নয়। তার শারীরিক সৌন্দর্যও খুব আকর্ষণীয় নয়। এ কারণে তার কাছে সুন্দরী স্ত্রী ছিল এতদিনকার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বপ্নকে সত্য করার মতো।’
আবার অনেক মানুষ আলোচনা করছে শুধুমাত্র বিচ্ছেদ নিয়ে। ওয়াং অভিযোগ করেছেন, তাদের যৌথ সমপত্তির অনেক কিছু অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন বা গোপন করেছেন তার স্ত্রী। এ দমপতি বেশ ধনী। চীনা গণমাধ্যমের মতে, নয়টি ফ্ল্যাট, বিএমডব্লিউ কার ও অনেক বিলাসবহুল দ্রব্য রয়েছে তাদের মালিকানায়। ফলে বিয়ের পরও নিজস্ব সমপত্তি রক্ষার ইস্যুতে মানুষ বিতর্ক করছে। অনেকে বলছে, এ সম্পত্তি অর্জন করেছেন ওয়াং। কিন্তু বিয়ের কারণে সেখানে ভাগ বসিয়েছেন তার স্ত্রী। চীনে বিচ্ছেদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে পাল্টাচ্ছে। বিচ্ছেদের হারও দেশটিতে ঊর্ধ্বমুখী। রাষ্টায়ত্ত পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস বলছে, ২০১৫ সালে ৩৮ লাখেরও বেশি দম্পতির  ছাড়াছাড়ি হয়েছে, যা ২০১৪ সালের চেয়ে ৫.৬ শতাংশ বেশি। চীনে শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারের কারণে বিয়ে ও বিচ্ছেদ- উভয় ইস্যুতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। কিন্তু এখনও চীনা সমাজে একটি ধারণা প্রবল যে, পুরুষরাই সম্পত্তির পরিচালনা বা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকবে আর নারীরা দেখাশুনা করবে পরিবার।