আর্থিক দ্বন্দ্ব ও বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতায় ‘নিউ জেএমবি’র আধ্যাত্মিক গুরু এবং একাংশের আমির ডাক্তার নজরুল ইসলামকে দলের কর্মীরাই খুন করে। সংগঠনটির বিভিন্ন সারির জঙ্গি তাকে ‘বড় হুজুর’ বলে সম্বোধন করত। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর আটক জঙ্গিদের কাছ থেকেই নিউ জেএমবির এই আমিরের বিষয়ে জানতে পারেন গোয়েন্দারা। তার নির্দেশেই জেএমবি নতুন কৌশলে টার্গেট কিলিংয়ে নামে। তবে নজরুল হত্যার বিষয়টি এ সংগঠনের অনেক সদস্যই (জঙ্গি) এখনও জানে না।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, নিউ জেএমবির শুরুর দিকেই আর্থিক বিষয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ কারণে ডাক্তার নজরুলকে জেএমবির জঙ্গিরাই খুন করে। আটক এক জঙ্গি প্রাথমিকভাবে এ তথ্য দিয়েছে। এ বিষয়ে আরও তথ্য জানতে গোয়েন্দারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, নতুন ধারার জেএমবির এ নেতাকেই অনেকদিন ধরে খোঁজা হচ্ছিল। তার মৃত্যুর বিষয়টি জঙ্গিদের আটক করার পরই জানা গেল।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে নিউ জেএমবির সাত সদস্যের একটি মজলিশে শূরা গঠন করা হয়। এর সদস্যরাই নজরুলকে খুনের পর লাশ গুম করে। গুলশান হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের ঘনিষ্ঠ এক জঙ্গি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ তথ্য দিয়েছে। সে জানিয়েছে, নজরুল খুনের পুরো বিষয়টি মারজান জানে এবং খুনের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন সে। চলতি সপ্তাহেই তাকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তাকে ধরতে পারলে ডাক্তার নজরুলের লাশ কোথায়, তাও জানা যাবে বলে তিনি জানান।
আটক ওই জঙ্গি আরও স্বীকার করেছে, মারজান নিউ জেএমবির সাত সদস্যের মজলিশে শূরা বোর্ডের অন্যতম সদস্য। বোর্ডের সব সদস্যের ওপর আর্থিক, সামরিক ও অপারেশনাল দায়িত্ব ছিল। অন্য সদস্যরা হল- তামিম আহমেদ চৌধুরী, মানিক (মাইনকা), রিপন, খালিদ, আজাদুল ও বাদল। এদের পরিকল্পনায় সারা দেশে হামলা চালানো হতো। আর ডাক্তার নজরুল ছিলেন এ সাতজনের নেতা। তার হাত ধরেই নিউ জেএমবি নতুন কৌশলে হামলা শুরু করে। এদের হাতে প্রচুর অর্থ দিয়েছে একটি গোষ্ঠী। শূরা বোর্ডের সদস্য মারজান, রিপন ও খালিদের মাধ্যমে এসব অর্থ আসে। এ অর্থ নিয়েই ২০১৫ সেপ্টেম্বরে দ্বন্দ্ব শুরু হতে থাকে। তারপরই কোনো একসময় নজরুলকে হত্যা করা হয়। তবে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখে জঙ্গিরা। নজরুলের অবর্তমানে তামিম আহমেদ চৌধুরী জেএমবির এ অংশের প্রধানের দায়িত্ব নেয়।
আটক ওই জঙ্গি আরও জানায়, ডাক্তার নজরুল ২০১৫ সালের প্রথম দিকে কারাবন্দি এক জঙ্গির স্ত্রীকে জোর করে বিয়ে (দ্বিতীয়) করেন। পরে ওই নারীকে নিয়ে ময়মনসিংহে থাকা শুরু করেছিলেন। এ নিয়েও জঙ্গিদের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গোয়েন্দারা এ বিষয়ে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে গ্রেফতার নিউ জেএমবির সদস্য সুজন ওরফে বাবু পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ডাক্তার নজরুল সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য দিয়েছিল। ওই সময় চট্টগ্রামে পুলিশ পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে, যাদের সবাই ডাক্তার নজরুলের নাম বলেছিল। তার সঙ্গে চট্টগ্রামের জেএমবির কমান্ডার ফারদিনের সম্পর্ক ছিল। আর ফারদিন ও মারজান একসঙ্গেই ডাক্তার নজরুলের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে।
আটক জঙ্গির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দারা মানিক নামে মজলিশে শূরার আরেক সদস্যের সম্ভাব্য অবস্থান জানতে পারেন। মানিককে নিউ জেএমবিতে মাইনকা বলে ডাকা হয়। গোয়েন্দারা আটক ওই জঙ্গিকে নিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন। এছাড়া কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক (চিকিৎসাধীন) জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের কাছ থেকেও এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। রাকিবুল হাসানের তথ্যানুযায়ী, ডাক্তার নজরুল তাদের আধ্যাত্মিক গুরু। নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে টার্গেট কিলিংয়ে নামার পেছনে নজরুলের নির্দেশনা ছিল। ডাক্তার নজরুল অনেক টাকার মালিক ছিল বলেও রিগ্যান জানত।
রাকিবুল হাসান আরও জানায়, নজরুল ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলের একটি জেলায় থাকতেন। তবে উত্তরাঞ্চলের জেলার নাম সে জানে না। গত বছর উত্তরাঞ্চল সফরকালে ডাক্তার নজরুল টার্গেট করে করে হত্যার নির্দেশনা দেন। ওই সফরের সঙ্গী ছিল গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নিউ জেএমবির বর্তমান একাংশের প্রধান তামিম চৌধুরী, কমান্ডার রিপন, খালিদ, মারজান, মানিকসহ আরও কয়েকজন। জানা যায়, এদের মধ্যে কমান্ডার রিপনসহ দু’জন ভারতে পালিয়ে গেছে। সেখানে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, ডাক্তার নজরুলের নির্দেশনা সবাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে- সেই বয়না শোনাতে হতো কিলিং মিশনের জঙ্গিদের। তাদের আরও বলা হতো, তিনি হঠাৎ একদিন আবার আসবেন। মৃত্যুর পর খুনিরা ডাক্তার নজরুলের সব সম্পদ লুট করে বলে জানা গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.