প্রিয় আলি, তোমার চেষ্টাটা ভালোই ছিল। কিন্তু তোমার ছোট ভাইটা একটু গড়বড় করে ফেললো। তাই তোমাকে নিয়ে এখন জোর হইচই শুরু হয়ে গেছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল আমাকে নিয়ে। কী সাংঘাতিক বিড়ম্বনা বলো তো! আমাদের মৃতদেহগুলো এই ভাবে বারবার সর্বসমক্ষে চলে আসা কি উচিত? বড়রা এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছেন। কতদিন ধরে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন! এই রকম একটা কাজের মধ্যে কি আমাদের মতো ছোটদের ব্যাঘাত ঘটানো উচিত? এতে বড়রা বিব্রত হন। তাঁদের কাজে বাধা পড়ে। কারা যেন আমাদের মৃতদেহ দেখলেই বা আমাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে দেখলেই ছবি-টবি তুলে একেবারে রাষ্ট্র করে দেয়। শুনেছি, আমাদের ওই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক মানুষ সে সব দেখেন। আর তার পরে খুব নাকি হইচই জুড়ে দেন। আমাদের দেশে বড়রা যে কাজে ব্যস্ত, সেই কাজটার নাকি খুব নিন্দা করতে থাকেন। আর বড়রা খুব অস্বস্তিতে পড়ে যান। আমরাই কিন্তু বার বার বড়দের জন্য এই অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছি। আমরা সিরিয়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতেই পারি। আর যদি নিজের জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা না করে, তা হলে চুপিচুপি গিয়ে কবরে লুকিয়ে পড়তে পারি। নিজেরাই যদি কবরে লুকিয়ে পড়ি তা হলে কেউ ছবিও তুলতে পারে না, আর এত হইচইও হয় না। আমি তো বাবা, মা আর দাদার সঙ্গে সিরিয়া ছেড়ে পালিয়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ। মাঝ সমুদ্রে নৌকা উল্টে গেল। আমরা সবাই জলে পড়ে গেলাম। মা আর দাদা কিন্তু বেশ চুপচাপ ডুবে গেল। আমার দেহটাই খামোখা ভেসে ভেসে তুরস্কের ঘাটে গিয়ে ঠেকলো। আর যাই কোথায়! ছবি-টবি তুলে একেবারে রাষ্ট্র করে দিলো! তুমি কিন্তু খুব চুপিচুপিই কাজটা সেরে ফেলেছিলে আলি। আলেপ্পোয় তোমাদের বাড়ির উপর যখন রুশ যুদ্ধবিমান থেকে বোমা পড়লো, তুমি তখন ধ্বংসস্তূপের তলায় খুব সুন্দর লুকিয়ে পড়েছিলে। তোমার ভাই ওমরানটা লুকাতে পারলো না। রক্তে ভিজিয়ে ফেললো গোটা শরীর। ছবি তুলছিল যে লোকটা, তার চোখকেও ফাঁকি দিতে পারলো না। গোটা দুনিয়া দেখে ফেললো ওকে। আবার সেই নিন্দা-মন্দ শুরু হয়ে গেল। সবাই বড়দের গাল দিতে শুরু করলো। তোমার শরীর আরো বেশি ভিজে গিয়েছিল রক্তে। কিন্তু তুমি অসাধারণ দক্ষতায় ক্যামেরাকে ফাঁকি দিয়েছিলে। তাই তোমার ছবি কেউ দেখতে পায়নি। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। ওমরানকে ততক্ষণে তো সবাই চিনে গিয়েছে। সেই ওমরানের দাদা তুমি। তুমি কবরের দিকে যাচ্ছো। সে খবর কি আর গোপন থাকতে পারে? অতএব, আবার হইচই শুরু হয়ে গেল! এই ভাবে বার বার বড়দের বিড়ম্বনায় ফেলা কি উচিত হচ্ছে আলি? কত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছেন ওঁরা! আমরা বার বার ওঁদের লজ্জায় ফেললে কী করে চলে? প্রথমে আমি, তারপর ওমরান, শেষে তুমি! এর পর আরো কত জন যে এই ভাবে বড়দের অস্বস্তি বাড়াবে জানি না। তাই চলো এবার একটা শপথ করি। কিছুতেই আর বড়দের বিরক্ত করবো না আমরা। কিছুতেই তাঁদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠবো না। গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাঝে তাঁদের আর বিব্রত করবো না। সবাইকে খবর পাঠিয়ে দাও আলি। যত দ্রুত সম্ভব নিজেদেরই গিয়ে কবরে লুকিয়ে পড়তে হবে। খুব চুপচাপ। কেউ যেন দেখতে না পায়। কেউ যেন ছবি তুলতে না পারে। ইতি আলান কুর্দি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.