আইএসের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের দুবছরের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো জয় আসতে যাচ্ছে। তবে, একইসময়ে, মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত পরিসরের ঘটনাবলির ওপর মার্কিন প্রভাব হয়তো কমছে বলে মনে হচ্ছে। সিরিয়ায় আগামী মাস ও বছরগুলোতে কী ঘটবে, সেটাই ওই অঞ্চলের ভবিষ্যতের রূপরেখা গড়ে দেবে। এর আগ পর্যন্ত কোনো দেশ মার্কিন নীতিনির্ধারকদের এত বেশি চ্যালেঞ্জ যেমন জানায়নি, তেমনি ওবামা প্রশাসনও এত সমালোচনার মুখে পড়েনি। এর মধ্যে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ মাসেই প্রথম সুসংবাদটি পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আগস্টের শুরুতে, মার্কিন সমর্থিত সিরীয় বাহিনী মানবিজ শহর দখলে নিতে সমর্থ হয়। ওই সময়ের ফুটেজে দেখা যায়, উল্লসিত স্থানীয় জনগণ সৈন্যদের নিজেদের মুক্তিদাতার মতো করে আলিঙ্গন করছে। ওয়াশিংটনের জন্য যে ধরনের বিজয়ের প্রপাগাণ্ডা প্রয়োজন ছিল, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এসব ছবি সেই চাহিদা পূরণ করেছে। প্রকৃত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের দ্বারই হয়তো খুলে দিয়েছে মানবিজ। আইএস দখল হারাচ্ছে, তাদের টাকা কমছে, সমর্থন কমছে। এদের বাকি রয়ে যাওয়া শক্তিশালী ঘাঁটি সিরিয়ার রাকা বা ইরাকের মসুলও হয়তো শিগগিরই তাদের ছাড়তে হবে। কিন্তু সিরিয়ার এবং অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের যে লড়াই তা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। এই লড়াইয়ে জয়ের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে শক্তিশালী বেশ কয়েকটি পক্ষের। এর মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া, ইরান এবং সিরিয়ারই বাশার আল-আসাদের অবশিষ্ট সরকারের কথা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরেই সিরিয়া ইস্যুতে অগ্রসর হওয়ার পথ বের করতে কষ্ট করেছে। বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর অবস্থান নেয়া যাবে, কিংবা তার বিরোধীদের কতটা সমর্থন বা বিশ্বাস করা যাবে- এসব বিষয় এখনও রয়েছে অমীমাংসিত। পক্ষ নির্বাচনে মস্কো সবসময়ই নিশ্চিত থেকেছে নিজেদের অবস্থানে। এ সপ্তাহে রাশিয়া ইরানের সীমানা ব্যবহার করে বিমান হামলা চালিয়ে চমকে দিয়েছে মার্কিন বিশ্লেষকদের। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর এই প্রথমবারের মতো ইরান সরকার তাদের সামরিক ঘাঁটি বিদেশি কোনো শক্তিকে ব্যবহারের অনুমতি দিলো। এটা রাশিয়া-ইরান জোটবদ্ধতার এক নাটকীয় ইঙ্গিত। সিরিয়া সরকার ও এর জোটের তীব্র আক্রমণের পটভূমিতেই এই আক্রমণ চালিয়েছে রাশিয়া। খবরে বলা হয়েছে, সিরিয়া সরকারের আক্রমণে এবারে রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, আলেপ্পোতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। এতে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং বিদ্যমান বিপর্যস্ত মানবেতর অবস্থা আরও খারাপের দিকে ধাবিত হয়েছে। অনেক দিক থেকেই সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদি লড়াই ও অবরোধের কাছে মানবিজ অনেকটাই পার্শ্বচরিত্রের মতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি বড় একটি অর্জন। এখানকার বিজয়ীরা কাগজে-কলমে হলেও ‘মৃদু সরকার বিরোধী’, যে ধরনের একটি অস্তিত্ব দৃশ্যমান হবে- এমনটি যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই মরিয়া হয়ে চেয়ে আসছে। এই ধরনের বিরোধী তৈরির প্রচেষ্টায় তারা যতটা অসফল হয়েছে তার প্রেক্ষিতে একে ছোট করে দেখার উপায় নেই। বাস্তবতা সবসময়ই ছিল একটু জটিল। কোনো কোনো তথ্য অনুযায়ী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফাইটারদের ৬০ শতাংশই কুর্দি। এই দলে সুন্নি এবং সিরিয়ার বাইরের যোদ্ধাও রয়েছে। ফলে এ ধরনের একটি শক্তিকে পশ্চিমা বিশ্বের ততটা পছন্দ করার সত্যিকারের কোনো কারণ নেই। সমালোচকরা বলেন, এটা কার্যত সিরিয়ার কুর্দি ওয়াইপিডি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এর অর্থ হলো- এই গোষ্ঠীর সাফল্যকে প্রতিবেশী তুরস্ক ও ইরাক অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখে। সিরিয়ার মূল সংঘর্ষকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত মধ্যপন্থি স্থানীয় শক্তি গড়ে তুলতে পারবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আর দেশটিতে শেষ পর্যন্ত শান্তি আসতে হলে কেবল সিরিয়াই নয়, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকেও সংশ্লিষ্ট হতে হবে। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী ভূ-রাজনীতি এখন অনেকটাই স্পষ্ট মনে হয়। মস্কো নিজেদের অবস্থানকে শিয়া-প্রধান তেহরান-দামেস্ক অক্ষের দিকে দৃঢ় করেছে। একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্র এর আঞ্চলিক সুন্নী অংশীদার, সুনির্দিষ্টভাবে সৌদি আরব ও তুরস্ক থেকে আরও বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। এটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্য সমালোচনার কারণ নয়, ইতিহাসই তাকে এ ধরনের একটি দুঃস্বপ্নের মতো সময় এনে দিয়েছে। জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের প্রবল হস্তক্ষেপের নীতি আর কার্যকর ছিল না। সেটা অনেক দিক থেকে অনেক বেশি ব্যয়বহুলও ছিল। ওবামা আবার সুনির্দিষ্টভাবে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার সাফল্যের দাবিদার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- যে ধরনের সামরিক কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে এখন চালিয়ে যাচ্ছে তা অনেক বেশি টেকসই। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের সামরিক ও কূটনৈতিক মনোযোগ প্রসারিত করা ছিল ওবামার একদম শুরুর দিকের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর ততটা নির্ভরশীল নয়। বরং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি দায়িত্বশীল ও শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই বলতে হবে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান চীন ও পুনরুত্থানের পথে থাকা রাশিয়াকে মোকাবিলা করার কথা। মস্কোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিই আসলে গোটা চিত্রকে মার্কিনিদের জন্য জটিল করে তুলেছে। রাশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন বিরোধী শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে যারা মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলিকে বদলে দেয়ার মতো সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে চান, যা আগে পশ্চিমা শক্তির হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইরাক ও আফগানিস্তানে ভারি সৈন্যদলের মিশন পরিচালনা করতে মস্কো বা ওয়াশিংটন কেউই আগ্রহী নয়। এটা ভিন্ন একটি লড়াই, যা স্থানীয় শক্তিগুলো বাইরের শাক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থন ও পরামর্শ নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ চাইলেও সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বাহিনীকে দুর্বল করে দেয়ার মতো আঘাত হানার ইচ্ছা নেই ওয়াশিংটনের। এ ধরনের পদক্ষেপ কোনো না কোনোভাবে সিরিয়ার চলমান দুঃস্বপ্নকে আরও প্রলম্বিত করতে পারে। পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার স্বত্বাধীন কোনোকিছুর ওপর আঘাত কোনোভাবেই চিন্তায় নেই ওয়াশিংটনের। এটা হবে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। পুতিন ও আসাদের অনিয়ন্ত্রিত নৃশংসতার সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় হতাহতের ঘটনা ও নিজেদের ক্ষতি এড়ানোর জন্য ওয়াশিংটনের সীমিত পদক্ষেপের মধ্যে স্পষ্টতই নৈতিক একটি পার্থক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও পশ্চিমারা যেমনটি বিশ্বাস করে আসছে, তাদের নৈতিক ভিত্তি ততটা উচ্চ নয়। যেমন: যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তি সৌদি আরব ক্রমবর্ধমানভাবে ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ চালিয়ে গেলেও ওয়াশিংটন তা গোচরে আনছে না। আসছে নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে যে প্রার্থীই বিজয়ী হোন, তিনি চাইবেন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ভূমিকাতে নিজেদের চিহ্ন রেখে যেতে। তারা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করবেন তখন সিরিয়ার পরিস্থিতি কী থাকবে সেটা অনেক বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে। এর অর্থ হলো- আসছে সপ্তাহ ও মাসগুলোতে সব পক্ষের সামনেই করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। পরিস্থিতি সরল হয়ে দাঁড়াবে- এমনটি নিকট ভবিষ্যতে আশা করার কোনো কারণ নেই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.