এখন আমার বয়স বিরাশি। তখন ছিল খুবই কম। চার কি পাঁচ হবে। ১৯৪১ সালের কথা। নেমেছিলাম ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে। সেই সময়ের ঢাকাকে কতটা বুঝতে পেরেছি, কতটা পারিনি। মেশোমশাই চাকরি করতেন নবাব স্টেটে। তিনি আমাকে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে নিতে আসেন। রেলগাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। মেশোমশাইকে দেখলাম একটি হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ সেই রেলস্টেশনও নেই; সেই ফুলবাড়িয়াও নেই। মানবজমিনের কাছে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন কবি নীলাচার্য। প্রকৃত নাম সুনীলকুমার ভট্টাচার্য। কলকাতায় বেড়ে উঠলেও তিনি এই বাংলার সন্তান। বিক্রমপুরের চিত্রকরা পাঁচগাঁও গ্রামের অবস্থাপন্ন ভট্টাচার্য পরিবারে জন্ম। ১৯৩৫ সালের ৪ঠা মার্চ জন্ম হলেও ১৯৪৪ সালে নয় বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় যাওয়া। পরে সেখানেই সার্ভে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সফলতা। পেশার বাইরে সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে লেখালেখি করেন। পঁচাত্তরে এসে শুরু করেছেন ছবি আঁকা। তাঁর স্মৃতিতে অন্যরকম এক ঢাকার ছবি ভেসে ওঠে মানসপটে। নীলাচার্য বলেন, প্রথম যেদিন ঢাকায় আসি তখন দেখেছিলাম সারি সারি এক্কাগাড়ি রেলস্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো। চড়েছিলাম এক্কাগাড়িতে। ২০১৬-তে এসে এক্কাগাড়ি চোখে পড়েছে। তবে তা বন্দি হয়ে আছে ইটপাথরে। সড়কদ্বীপের মনুমেন্টে।
সেদিনের সেই এক্কাগাড়ির কোচোয়ানের রসিকতা আজও মনে হলে হাসি পায়। ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি করতে চাইলেই কোচোয়ান বলে উঠতেন, ‘কত্তা আস্তে কন, ঘুরায় হুনলে হাইসবো’। তখনকার ঢাকা ছিল একেবারেই অন্যরকম। বর্তমান ঢাকার সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাই না। আমার মেশোমশাই থাকতেন ওয়ারীতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার সহধর্মিণী মঞ্জুলা ভট্টাচার্যের জন্ম এই ওয়ারীতেই। নানা কারণে ওয়ারী স্মৃতিবিজড়িত। তখনকার ওয়ারী ছিল প্রচুর গাছপালা আর সবুজে ছাওয়া। রাস্তা ছিল সরু। কোনো উঁচু বাড়ি ছিল না। পরিবর্তনের চিত্র মিলিয়ে দেখলে ২০০৮ সালকেও আমলে নিতে হয়। সেবার কবি ও লেখক সাযযাদ কাদিরের আমন্ত্রণে একটি সম্মাননা গ্রহণের জন্য ঢাকায় আসি। নিজের জন্মভূমি চিত্রকরা গ্রামে আমার প্রায় সমবয়সী অযত্নে লালিত জীর্ণ সেই নির্জন দালান কোটাবাড়ির জীর্ণদশা দেখতে যাওয়ার প্রাক্কালে যখন ওয়ারীর পাশ দিয়ে গেলাম, পুরনো স্মৃতির কোনো চিহ্নই খুঁজে পাইনি। আরেকটু বলতে গেলে, ২০০৮ সালের পর আমি প্রতিবছরই একবার কিংবা দুবার করে ঢাকায় এসেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। যদি ২০০৮ সালের সঙ্গে আজকের ২০১৬ সালের ঢাকার তুলনা করি তাহলেও মনে হয় অনেক কিছু পালটে গেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ফ্লাইওভার, হাইরাইজ বিল্ডিং বা শপিং মলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এবারের ভ্রমণে ফরাশগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পুরনো স্মৃতি আমাকে নাড়া দিয়েছিল। ১৯শে আগস্ট শুক্রবার আমাকে দেয়া ঢাকা কেন্দ্রের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সময় পুরনো অনেক স্মৃতি খুঁজে পেয়েছি। না বলা সত্ত্বেও তখন কোলাহল বাড়ন ছিলাম। আর এখন অবস্থা হয়েছে উল্টো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, কোলাহল তো বাড়ন হলো। এই যে কোলাহলযুক্ত পরিবেশ, যারা তথাকথিত প্রগতির তালে পথ চলতে চায়, এ পথকে সেই পথ মনে হয়। আমাদের মতো পরিপক্বদের এ পথে হেঁটে চলতে কষ্ট হয়। বলতে হয়, ‘ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, লও হে নগর।’ প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকা আজ যে মহানগরে পরিণত হয়েছে তাতে আমি খুশি। জানতে পেরেছি এখানে মেট্রোরেলের কাজও শুরু হয়েছে। এখানে আসার প্রথমদিন ঢাকা স্টেট রেলওয়েতে চড়েছি আর এখন মেট্রোরেলে চড়ার স্বপ্ন দেখছে এই শহরবাসী। এখন আমার বয়স বিরাশি বছর। যদি এরপর বেঁচে থাকি এবং ঢাকায় আসতে পারি তাহলে হয়তো মেট্রোরেলে চড়বো। বর্তমানে ঢাকায় যা সবচেয়ে যন্ত্রণাময় তা হলো যানজট। যা ঢাকাতেও আছে, কলকাতাতেও আছে। ২০০৮-এ ঢাকা ভ্রমণের সময় যানজট যেমন দেখেছি এখনও সেরকমই আছে। জানি না মেট্রোরেল হলে যানজটের কোনো সমাধান হবে কিনা। আমার নিজস্ব সংযোজনের জন্য ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমি ঢাকার অনেক মানুষকে আন্তরিকতার দিক দিয়ে সম্পর্কে আপন ভাই-বোনের চেয়ে কম পাইনি। এমনদের সংখ্যা অজস্র। দাদাকে কে কী খাওয়াবে; দাদার জন্য কে কী করবে; কে কী দেবে; দাদা কী করলে ভালো থাকবে? সব মিলিয়ে বিরাশি বছরের বৃদ্ধের পঞ্চত্বপ্রাপ্তির আগে এটা বিরাট প্রাপ্তি। হয়তো অন্য যে কারো জন্য এটা ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেও কখনও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিশেষ কোনো আকর্ষণ থাকে না। একমাত্র যারা প্রাণের ভাই-বোন হয়ে গেছে তাদের সঙ্গে পুনর্মিলনের এক অজুহাত (ছুতা) ছাড়া। এটা আমার জন্মভূমি। তখন পাকিস্তানও ছিল না, বাংলাদেশও ছিল না। কিন্তু এই মাটি একইভাবে ছিল। তখন ছিল ঢাকা জেলা স্বতন্ত্র। মুন্সীগঞ্জ ছিল মহকুমা। এখন তা জেলা। আমি সেদিনের সেই ঢাকার পোলা আজীবন-আমৃত্যু আছি, থাকবো। সেদিনের শিশু সুনীলের চোখ দিয়ে দেখা আজকের নীলাচার্যের পক্ষে সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে যেমন বলতে পারি, তখন তারাপাশা স্টিমার স্টেশন থেকে পদ্মার বুকে নৌকো বেয়ে বিভিন্ন খাল-বিল পেরিয়ে বাড়ির ঘাটে পৌঁছানোর যে দৃশ্য মনের মধ্যে আছে- পদ্মার বিস্তীর্ণ যে এপার থেকে ওপার না দেখার স্মৃতি আছে, পদ্মার উদ্দামতা, নৃশংস পাড় ভাঙার সেদিনের যে ছবি চোখে ছিল, আজকের পদ্মার সঙ্গে তার মিল নেই। ২১শে আগস্ট ২০১৬-তে পদ্মার পাড়ে মাওয়া ঘাটে গিয়ে পদ্মার যে রূপ দেখেছি তা আমাদের বাড়ির পাশে অর্থাৎ চিত্রকরা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সংকীর্ণ যে পদ্মাকে দেখেছি বর্তমানে সে তুলনায় অবশ্যই অনেক বিস্তীর্ণ হলেও সেদিনের সেই বিস্তীর্ণ পদ্মা, তার পাড় ভাঙার নৃশংস চেহারা, যা নৌকো করে তারপাশা থেকে বাড়ির ঘাট পর্যন্ত পৌঁছানোর সময় দেখেছি, আজ তার চিহ্নও নেই। বয়সের ভারে আমার মতো আজ সেও শান্ত হয়ে গেছে। একটা কথা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলি, আন্তরিকতা আর আতিথেয়তা আমরা কাঁটাতারের ওপারে থুই আইছি। ওখানে বেশিরভাগ বাড়িতে একজন অতিথিকে চা খাওয়াতে চাপবোধ করে। এপারে সকাল-দুপুর-বিকাল দুটো ডাল-ভাত খাওয়াতে কোনো সমস্যা হয় না। কারো সামর্থ্য না থাকলেও নাড়ির টান বলে একটা ব্যাপার আছে। কলকাতা মেট্রোপলিটন সিটি। সেখানে ভাষার মিশ্রণ ইংরেজি, বাংলা এবং কিঞ্চিত হিন্দি উপসর্গ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আজকের ঢাকায়ও ভাষার মিশ্রণ ঢুকে পড়েছে। এটা শুধু ভাষা নয়, ভাষা সংস্কৃতি সাহিত্য সবকিছুতেই বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার মিশ্রণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেজন্য এলিট ক্লাসের (অভিজাত) সন্তানরা বোধহয় দুই বাংলাতেই একইভাবে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যায়। সংখ্যার তারতম্য হতে পারে। কিন্তু এই একটি জায়গা, যেখানে বাঙালি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দুই বাংলার মধ্যে সবচেয়ে মিল বেশি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.