ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর আপিলের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ রিভিউ আবেদনটি নিষ্পত্তি করে গতকাল মঙ্গলবার রায় দেন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমউদ্দিনকে অপহরণের পর নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যার দায়ে আলবদর বাহিনীর জেলা কমান্ডার মীর কাসেমকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকল। এটিই ছিল আইনি লড়াইয়ের শেষ ধাপ। তবে মীর কাসেম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। যদিও এর আগে কোনো যুদ্ধাপরাধীরই প্রাণভিক্ষা প্রাপ্তির নজির নেই। প্রাণভিক্ষা না চাইলে বা প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। রিভিউ খারিজ আদেশের কপিতে গতকাল বিকেলেই স্বাক্ষর করেছেন প্রধান বিচারপতিসহ বেঞ্চের বিচারপতিরা। পরে তা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিকে, রিভিউ আবেদন খারিজের পর কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ ও জল্লাদ প্রস্তুত করা হয়েছে। আদেশের কপি কারাগারে পেঁৗছানোর পর দণ্ড কার্যকর করা হবে। এই দণ্ড কার্যকরের প্রতীক্ষায় গোটা জাতি।
রায় ঘোষণার আগের দিন সোমবার সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছিলেন, আমি ভেতরে ভেতরে ভীষণ উদ্বিগ্ন। তার এই উদ্বেগ প্রকাশের পর জনমনেও শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। অনেকের মধ্যে শঙ্কা ছিল_ জামায়াতের অর্থ জোগানদাতা ধনকুবের মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল থাকবে কি-না। তবে শেষ পর্যন্ত সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে মীর কাসেমকে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের দেওয়া ২৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল সন্ধ্যায় বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের পর রায়ের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা
ম্যাজিস্ট্রেট, আইন মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় কারাগারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রায়ের কপি রাতেই কাশিমপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মীর কাসেম আলীকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে রায় পড়ে শোনানো হবে বলে সমকালকে জানিয়েছেন কাশিমপুর কারাগার-২-এর জেলার নাসির আহমেদ। তিনি বলেন, মীর কাসেমের কাছে জানতে চাওয়া হবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না।
মীর কাসেম এখন কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। সেখানে বসেই তিনি গতকাল দুপুরে এক ব্যান্ডের রেডিওতে রায়ের খবর শুনেছেন বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
আপিল বিভাগের এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন_ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি বজলুর রহমান। গতকাল সকাল ৯টা ৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এজলাসে বসেন। এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পিটিশন ইজ ডিসমিসড।’ রিভিউ আবেদনটি খারিজ করে রায়ে বলা হয়, ‘উই ফাউন্ড হিম গিল্টি, কনভিকশন ইজ মেইনটেইনেবল।’
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, মীর কাসেমের মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের ১৪ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে রিভিউয়ে একটি সংশোধনী এসেছে। ১৪ নম্বর অভিযোগে নাসিরউদ্দিনকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করার কথা আছে। সে জন্য আসামির ১০ বছরের সাজার বিষয়টি আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন; কিন্তু রায়ের অপারেটিং অংশে সেটা উল্লেখ ছিল না। সেটাই সংশোধন করা হয়েছে।
এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ আদালতে সাতজনের আপিল নিষ্পত্তি হলো। মীর কাসেমের রায়ের পর বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশেষ গুরুত্ব সহকারে সংবাদ প্রকাশ করেছে।
শেষ ধাপ প্রাণভিক্ষা :রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর চূড়ান্ত আইনি লড়াই শেষ হলো। রিভিউ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাঠানোর পরে সরকারের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় দণ্ড কার্যকর করতে পারবে। তবে মীর কাসেম একাত্তরে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। এ বিষয়টির নিষ্পত্তির পর সরকার দ কার্যকর করবে।
২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে মীর কাসেম কাশিমপুর কারাগারে আছেন। তার ফাঁসি বহাল রাখার প্রতিবাদে আজ বুধবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী। মীর কাসেমের রিভিউ খারিজের পর কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার ও আশপাশের এলাকায় সতর্কতা বাড়ানো হয়। কারাগারের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়।
প্রতিক্রিয়া :মীর কাসেমের রিভিউ খারিজের পর স্বস্তি প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, আপিল বিভাগে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এ পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, এ রায়টিও কার্যকর হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘যে আশা নিয়ে সমগ্র জাতি অপেক্ষায় ছিল এবং আমি ছিলাম, আজ তা পূর্ণ হয়েছে। উদ্বেগের অবসান হয়েছে। একজন আইনজীবী হিসেবে এই মামলা পরিচালনা করেছি। তাই রায়ের আগে সব আইনজীবীর মতোই আমিও উদ্বিগ্ন ছিলাম।’
মীর কাসেমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যে সাজানো সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দণ্ড দেওয়া হয়েছে তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, এখানে ফান্ডামেন্টাল রাইটস কাটল করা হয়েছে। রায়টি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যালোচনা করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। আসামি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তাদের বিষয়।
প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রায়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছি। তিনি বলেন, ‘রায় নিয়ে আমরা শঙ্কিত ছিলাম। বাংলাদেশ এখন কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।’
গতকাল আপিল বিভাগে মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজের পরপরই আদালতের বাইরে ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও সন্তোষ প্রকাশ করে ‘বিজয় মিছিল’ বের হয়। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার এই যুদ্ধাপরাধীর রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে জানিয়েছে ১৪ দল। মীর কাসেমের ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ। রায়কে অভিনন্দন জানিয়ে দ্রুত রায় কার্যকর করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার, সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় মীর কাসেম আলীর জন্মস্থান মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে আনন্দ মিছিল বের করে বিভিন্ন দল ও সর্বস্তরের মানুষ।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিল থেকে মীর কাসেমকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে দশটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি (১১ ও ১২ নম্বর) অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ৮টি অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগ একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
কঠোর নিরাপত্তা বলয় :আপিল বিভাগে মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদনের রায় ঘোষণা উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ঘিরে গতকাল সকাল থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটকে ভোর থেকে পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়। এ ছাড়া আপিল বিভাগে প্রবেশের মুখে বসানো আর্চওয়েতে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়। যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে সর্বোচ্চ আদালত এলাকায় অবস্থান নেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
কাশিমপুর কারাগার প্রস্তুত :কাশিমপুর কারাগারে বন্দি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী তার রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার খবর শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। গতকাল মঙ্গলবার গাজীপুরের কাশিমপুর-২ কারাগারে বন্দি কাসেম প্রথমে রেডিওতে রিভিউ খারিজের খবর জানতে পারেন। এর পর কারারক্ষীদের মাধ্যমেও তিনি একই তথ্য পেয়েছেন। তবে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও ধনকুবের গতকাল দুপুর ও বিকেলে কারা কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ করা খাবার খেয়েছেন।
এদিকে প্রাণভিক্ষা চাওয়া বা না চাওয়ার বিষয়টির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সর্বশেষ আইনি ধাপ পার হওয়ার পর কোথায় ফাঁসি কার্যকর হবে_ এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কাশিমপুর-২ কারাগারেই দণ্ড কার্যকর হবে, নাকি কেরানীগঞ্জে নতুন কারাগারে_ তা নিয়েও আছে অনেক জল্পনা। তবে একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কাসেম আলীর ফাঁসির দণ্ড কাশিমপুর কারাগারেই হতে পারে।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জেলার মো. নাসির আহমেদ বলেন, কারাগারে বন্দিরা চাইলে রেডিও রাখতে পারেন। সেই রেডিওতেই মীর কাসেম আলী সকালে রায়ের খবর জেনেছেন। আগে তাকে বেশ শক্ত দেখা গেলেও রায় শোনার পর অনেকটা বিমর্ষ মনে হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.