গুম বা নিখোঁজের প্রসঙ্গটি আবার আলোচনায় এসেছে। তিন বছর আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া ২০ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা স্বজনদের ফিরে পেতে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের হৃদয়ের আকুতি জানান। ঠিক প্রায় একই সময়ে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে গুম বলে কোনো শব্দ নেই, কেউ গুম হয়েছে এমনটি জানা নেই। যারা গুম হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা বিভিন্ন কারণে আত্মগোপনে রয়েছে।’ পরদিন সোমবার এ কথার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘এটা তো প্রমাণিত, এর আগে অনেকেই গুম হয়েছেন বলে তাদের স্বজনরা দাবি করেছিলেন; পরে দেখা গেছে তাদের অনেকে ফিরেও এসেছেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যে কিছু ক্ষেত্রে সত্যতা থাকলেও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া এবং বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকা ব্যক্তির সংখ্যাটি কিন্তু ছোট নয়। মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে গুম হয়েছেন ২৩০ জন। এর দায়ভার বস্তুত সরকারের ওপরই বর্তায়। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক গুম বা নিখোঁজ হলে তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো সরকারেরই। যদি কেউ স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকেন, তাদেরও খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের সংবাদ সম্মেলনটি নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। হতে পারে নিখোঁজদের বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে সরকারকে বুঝতে হবে, এই সংবাদ সম্মেলনের চরিত্র যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি মানবিক। এটা ঠিক, রাজনীতি করলে জেল-জুলুমের শিকার হতে হয় কখনও কখনও। এই ভয় উপেক্ষা করেই বিরোধী দল রাজনীতি করে থাকে। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু জেল-জুলুম-হয়রানির ভয় উপেক্ষা করেই শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এর ফলও পেয়েছি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে কেউ নিখোঁজ হয়ে যাবেন এবং বছরের পর বছর জানাও যাবে না তিনি জীবিত না মৃত- এটা হতে পারে না। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি যেমন, তেমনি পাওয়া যায়নি নিখোঁজ হওয়া অনেক সাধারণ মানুষের সন্ধান। এদের গুম করা হয়েছে র্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে। যদি সত্যি সত্যি আইনশৃংখলা বাহিনীই তাদের গুম করে থাকে, তাহলে তা এক বড় দুঃসংবাদ। সেক্ষেত্রে এই প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে, তাহলে দেশে আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না। আর যদি আইনশৃংখলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে অন্য কোনো পক্ষ গুম করে থাকে, তাহলেও প্রশ্ন উঠবে, আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? অথবা নিদেনপক্ষে গুম হওয়া ব্যক্তির লাশটারও সন্ধান মিলছে না কেন? বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জনগণের অর্থের বিনিময়ে প্রতিপালিত আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যর্থতা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। আমরা এ দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করি। মোট কথা, নিখোঁজ ব্যক্তিরা কেন নিখোঁজ হলেন, কারা তাদের গুম করল এবং তাদের বর্তমান অবস্থা কী- এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাই আমরা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.