একটি ডায়েরিই কাল হলো নব্যধারার জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান মুরাদ ওরফে কথিত মেজর মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর আলমের। ডায়েরিটিতে থাকা একটি ভাড়াটিয়া ফরমের সূত্র ধরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে মুরাদের আস্তানার হদিস পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে গত শুক্রবার রাতে ওই বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেই অভিযানেই নিহত হন জঙ্গি মুরাদ।
পুলিশ সূত্রগুলো জানায়, গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার জঙ্গি আস্তানা থেকে ডায়েরিটি জব্দ করা হয়। এর ভেতরে রূপনগরের বাসার ভাড়াটিয়া ফরমের একটি খসড়া কপি ছিল। অবশ্য তাতে কোনো বাসার ঠিকানা ও ছবি ছিল না। তবে ফরমে দেওয়া অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের সদস্যরা নিশ্চিত হন রূপনগরের বাসার ঠিকানা। সূত্র আরও জানায়, কানাডাতে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে মুরাদের পরিচয় হয়। গত এপ্রিলে মুরাদ নব্যধারার জেএমবিতে যোগ দেন।
কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মুরাদের অবস্থান সম্পর্কে তারা আগেই ধারণা পান। পরে রূপনগর থানায় গিয়ে অসংখ্য ভাড়াটিয়া ফরমের ভেতর থেকে ছবি ও সাংগঠনিক নাম দেখে জঙ্গি মুরাদের বাসা শনাক্ত করা হয়। এরপর রূপনগর থানার ওসি ও ইন্সপেক্টরকে (তদন্ত) বিষয়টি জানান তারা। পাশাপাশি অবহিত করেন ওই বাড়ির মালিককে। শুক্রবার মুরাদ বাসায় এলে পুলিশের কাছে খবর চলে যায়। পরে রূপনগর থানার ওসির নেতৃত্বে একটি টিম সেখানে গিয়ে নিশ্চিত হয় মুরাদ বাসায় আছেন। এ সময় তারা বাসার দরজার বাইরের ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। এদিকে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মুরাদ উপর্যুপরি লাথি মেরে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসেন। তখন পুলিশ তাকে ধরে ফেললে তিনি হাতে থাকা কমান্ডার নাইফ দিয়ে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ও ওসির ওপর আঘাত করতে থাকেন। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে পুলিশের অন্য সদস্যরা গুলি করলে ঘটনাস্থলেই মুরাদের মৃত্যু হয়। বাসায় ঢুকে দেখা যায়, রেফ্রিজারেটর থেকে মাংস ও বরবটি বের করে রাখা। দেখে বোঝা যায়, তিনি রান্নার আয়োজন করছিলেন। এদিকে গত ২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় নিজের স্ত্রী-সন্তানদের অন্যত্র রেখে আসেন সংগঠনে মেজর নামে পরিচিত এই জঙ্গি।
এদিকে গতকাল মুরাদের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। ময়নাতদন্ত শেষে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, গুলিতেই মুরাদের মৃত্যু হয়েছে। তার দেহে মোট ৯টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাথায় ৩টি এবং হাত, পা ও বুকে ৬টি গুলির চিহ্ন রয়েছে। সব গুলিই শরীরের একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার এক হাত ও এক পা ভেঙে গেছে। ডা. সোহেল আরও জানান, ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নিহতের চুল, ইউরিন ও থাই মাসল সংরক্ষণ করা হয়েছে। কোনো গোয়েন্দা সংস্থা চাইলে এসব নমুনা দেওয়া হবে। মৃত্যুর আগে মুরাদ শক্তিবর্ধক কোনো ওষুধ সেবন করেছিলেন কিনা তা জানতে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য রক্তও সংগ্রহ করা হয়েছে।
গতকাল নিহত মুরাদের আঙুলের ছাপ নেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। এই ছাপ জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তার পরিচয় নিশ্চিত করবে কমিশনের অনুবিভা?গ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার ডিসি মাসুদুর রহমান জানান, মুরাদ রূপনগরের ভাড়া বাসায় সঠিক পরিচয় দিয়ে ওঠেননি। সেখানে নিজের নাম বলেছিলেন জাহাঙ্গীর। স্থায়ী ঠিকানাও ?ঠিক দেননি। তাই জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তার বাড়ি এবং প্রকৃত নাম বের করা হবে।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে রূপনগরের ওই জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকালে গুরুতর আহত হন ওসি শহীদ আলম ও ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শাহীন ফকিরসহ চার পুলিশ সদস্য। গতকাল স্কয়ার হাসপাতালে ওসি ও ইন্সপেক্টরের (তদন্ত) দেহে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রাখা হয়েছে তাদের; দুজনই শঙ্কামুক্ত।
চিকিৎসকরা জানান, শহীদের কোমরে এবং শাহীনের বাঁ কাঁধ এবং মাথায় ধারালো অস্ত্রের জখম রয়েছে। শাহীনের ডান পায়েও জখম রয়েছে। ঘটনার রাতে রূপনগর থানার ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রথমে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়। পরে তাদের স্থানান্তর করা হয় স্কয়ার হাসপাতালে।
জানা গেছে, গুলশানে জঙ্গি হামলার দিন রূপনগরের বাসার ভাড়াটিয়া ফরম বাড়িওয়ালার কাছে জমা দেন জঙ্গি মুরাদ। ওই ফরমে তিনি নিজের নাম লেখেন মো. জাহাঙ্গীর আলম। তবে তার প্রকৃত নাম জাহিদ হোসেন বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। মুরাদ ভাড়াটিয়া ফরমে বাবার নাম লেখেন মোখলেছুর রহমান। স্থায়ী ঠিকানা লেখেনÑ মোল্লাপাড়া, টাঙ্গাইল সদর। নিজেকে বিবাহিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তার স্ত্রী ও দুই কন্যার পরিচিতিও তুলে ধরেন। পেশা উল্লেখ করেন বেসরকারি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের সাইট অফিসার। শিক্ষাগত যোগ্যতা লেখেন বিএ অনার্স। রূপনগরের বাড়িতে আসার আগে তিনি বারিধারার জে ব্লকের ২১ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়িতে থাকতেন বলে উল্লেখ করেন। পূর্বের বাসা পরিবর্তনের কারণ হিসেবে লেখেনÑ অফিসে যাতায়াতের সুবিধার্থে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.