মাদার তেরেসাকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সাধু বা সন্ন্যাসী’ (সেইন্ট অব দ্য ক্যাথলিক চার্চ) হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কথা রয়েছে পোপ ফ্রান্সিসের। ১৯ বছর আগে ভারতের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বিবিসি’র রোম সংবাদদাতা হিসেবে ৫ দশক ধরে কাজ করছেন ডেভিড উইলি। আশির দশকের শেষের দিকে রোমের ফিউমিচিনো বিমানবন্দরে মাদার তেরেসার সঙ্গে তিনি এক ঘণ্টা সময় কাটান। এ নিয়ে তার একটি স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ ছেপেছে বিবিসি। মানবজমিনের পাঠকদের জন্য এর অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাই, যে নারীকে ইতিমধ্যেই কলকাতার ‘বস্তির সন্ন্যাসী’ ডাকা হয়, তিনি একাধারে নম্র, সাদামাটা, যত্নশীল মানুষ এবং পরিশীলিত একজন পর্যটক। তিনি অনবরত বিমানে করে দুনিয়া ঘুরে বেড়াতেন। তার স্বেচ্ছাসেবামূলক মিশনারিগুলো ঘুরে দেখতেন। এই ধর্মীয় শৃঙ্খলা বা অর্ডার তিনি ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই বোধ করি, রোমের কলিসিয়ামের পাশে তার মাদারহাউজে কিংবা ভারতে তার কোনো অনাথশালার বদলে, বিমানবন্দরের জনাকীর্ণতার মাঝে তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা সঠিক ছিল। আমরা একসঙ্গে অ্যারাইভাল শাখায় বসে ছিলাম। তিনি খুব দ্রুতই আমাকে হাসাতে সক্ষম হন, কারণ খুব গর্বের সঙ্গে তিনি তার এয়ার ইন্ডিয়া ট্র্যাভেল পাস দেখাচ্ছিলেন। ওই ট্র্যাভেল পাসে উল্লেখ আছে, আজীবন তিনি দুনিয়ার যেকোনো স্থানে বিনামূল্যে ভ্রমণ করতে পারবেন। এ উপহার তাকে দিয়েছিল ভারত সরকার। আমি বেশ কয়েক মাস ধরে তার একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তার রোম সদর দপ্তরের সেবিকারা আমাকে সুযোগ দিচ্ছিলেন না। অবশেষে একদিন তারা আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন, মাদার তেরেসা অমুক ফ্লাইটে করে ভারত থেকে আসবেন। এবং দেড় ঘণ্টা পর কানাডা চলে যাবেন। আমি চাইলে স্বল্পসময়ের জন্য বিমানবন্দরে তার সঙ্গে দেখা করতে পারি। খুব ছোট শারীরিক গড়ন তার। চেহারা ততদিনে কুঞ্চিত হয়ে গেছে। অ্যারাইভাল ডোর দিয়ে একাই বেরিয়ে আসেন তিনি, তাই সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলি। হাতের মুঠিতে একটি সাদা কাপড়ের ব্যাগ। পরনে নীল ছাঁটের সাদা সুতার শাড়ি আর একই রঙের মুখাবরণ। নিজের মিশনারির সদস্যদের জন্য একেই ইউনিফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যেহেতু ট্রানজিটে, আপনার লাগেজ নিতে হবে না?’ এ কথা জিজ্ঞেস করেই নিজেকে কিছুটা বোকা বোকা লাগলো। কারণ, আমার কথায় মনে হবে ব্যাগেজ ট্যাগ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু তিনি জবাব দিলেন, ‘না। আমি আমার দুনিয়াবি সব সম্বল এই ছোট্ট ব্যাগে ভরে একাই বহন করি! আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন খুবই সামান্য।’ ইহলৌকিকতা ও আধ্যাত্মিকতার মতো ভারী বিষয় নিয়ে আলোচনার আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম একজন জীবিত সাধু কীভাবে তার ভ্রমণের দিকগুলো সারেন, তা নিয়ে আরো তথ্য খুঁজে বের করার। বিশেষ করে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্রি ট্র্যাভেল পাস আমাকে কৌতূহলী করে তুললো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনো দেশে নেমে, করণীয় সাজান কীভাবে আপনি?’ তখনও মোবাইল ফোনের যুগ আসেনি। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত এয়ারপোর্টের কোনো কয়েন টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করি রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকে। অথবা রোমে এলে পোপ জন পলকে ফোন করি। এরপর তারা আমার জন্য একটি গাড়ি পাঠিয়ে দেন।’ আশির দশকের শেষের দিকে আমাদের ওই সাক্ষাৎ হয়েছিল। ততদিনে মাদার তেরেসার সিস্টার্স, ব্রাদার্স ও ফাদার্সরা ১৮০০ সেবিকা ও হাজার হাজার কর্মীর এক বিশাল আন্তর্জাতিক পরিবারে পরিণত হয়েছেন। এখন এ সংখ্যাটি প্রায় ৬ হাজার। তারা বিশ্বের ১৩৯টি দেশে সক্রিয়। তার সংগঠনের কার্যত কোনো আঞ্চলিক সীমা-পরিসীমা ছিল না। বার্লিন ওয়াল ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের বহু আগে থেকে তিনি পূর্ব ইউরোপে অনাথ আশ্রম ও আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠা এবং লোকজন সংগ্রহ করা শুরু করেন। ১৯৮৩ সালের দিকে তিনি হংকং-এ দুইটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তবে চীন এখন পর্যন্ত মাদার তেরেসার সংগঠনকে দেশটির দরিদ্র্যদের সেবা করার অনুমতি দেয়নি। আমাদের কথোপকথনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল প্রতি মিনিটে। মাদার তেরেসা এরপর আমাকে একে একে বর্ণনা করে যান অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী ও প্রতিবন্ধীদের সেবা করতে তার অকপট একনিষ্ঠতার কথা। তার নিজের ভাষায়, ‘সমাজজুড়ে ক্ষুধার্থ, বস্ত্রহীন, গৃহহীন, খোঁড়া, অন্ধ, কুষ্ঠরোগী ও যারা মনে করে তারা ভালোবাসাহীন, যত্নহীন ও অবাঞ্ছিত এবং যারা সমাজের বোঝায় পরিণত হয়েছে, যাদেরকে সবাই বর্জন করে চলে, তাদের সেবা করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য।’ পোপ দ্বিতীয় জন পল ১৯৮৬ সালে কলকাতায় অবস্থিত মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য মাদার তেরেসার বানানো আশ্রয়শালা সফর করেন। এরপর তারা দু’ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভ্যাটিকানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পোপের পাশে প্রায়ই দেখা গেছে মাদার তেরেসাকে। পরে ২০০৩ সালে রেকর্ড সময়ের মধ্যে তাকে ‘ব্রেসড অব দ্য রোমান ক্যাথলিক চার্চ’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পূর্ণ ‘সেইন্টহুড’ মর্যাদা পাওয়ার পূর্বে এটিই সর্বশেষ স্তর। আমাদের কথোপকথন চলার এক পর্যায়ে তার টরোন্টোগামী বিমান আসার ঘোষণা এলো। আমরা ডিপারচার হল পর্যন্ত একসঙ্গে হেঁটে গেলাম। হাতের মুঠোয় তখনও ধরা তার ছোট কাপড়ের ব্যাগ। কেউই চিনতে পারছিল না তাকে। আমার মনে হয়েছিল, ট্রানজিট জোন পার হতে থাকা বহু যাত্রীর ভিড়ে স্বয়ংক্রিয় দরজার ওপাশে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। আমি জানতাম যে, আমার সাক্ষাৎ হয়েছে একজন জীবন্ত সাধুর সঙ্গে। তিনি আমার হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছিলেন। জীবনের প্রতি আনন্দের যে অনুভূতি, তা তিনি আমার ভেতর সংক্রমিত করেছিলেন। এবং তিনি আমাকে হাসিয়েছিলেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.