মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএসের হাতে যৌনদাসী হয়ে জীবন কাটানো নারীর সংখ্যা কম নয়। এসব নারীদের বলতে গেলে জীবন কাটাতে হয় নারকীয় পরিবেশে। সেখানে ক্রমাগত ধর্ষিত হতে হয় তাদের। বিশেষ করে ইয়াজিদি নারীরা শিকার হয়ে থাকেন আইএসের বন্দি হিসেবে। তেমনই একজন নারী নাদিয়া মুরাদ। পুরো নাম নাদিয়া মুরাদ বাসি তাহা। অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো- তিনি পালিয়ে আসতে পেরেছেন ওই নরক থেকে। তারপর থেমে থাকেননি। সেখানে কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা জানিয়েছেন সবাইকে। পরিস্থিতি বদলে দিতে নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছেন। এ বছর ইউরোপের শীর্ষ মানবাধিকার পুরস্কার শাখারভ পুরস্কারও পেয়েছেন এই তরুণী। তার গল্পই তুলে ধরেছে ডয়েচে ভেলে। ২০১৪ সালের ১৫ই আগস্টের কথা কোনোদিন ভুলবেন না নাদিয়া মুরাদ। ওই দিন থেকেই তার নারকীয় দুর্দশার শুরু। তখন তার বয়স ১৯ বছর। আচমকাই বদলে যায় তার জীবনের গতিধারা। তিনি স্কুলে যেতেন। ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। নিজের একটি বিউটি সেলুন গড়ে তোলার স্বপ্নও দেখতেন নাদিয়া। ইরাকের কুর্দি ইয়াজিদি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনজার গ্রামে বাস করতেন তিনি। আইএসের হামলার ভয়ে অনেকেই অবশ্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। এমনই এক দিনে আইএস হামলা চালায় সিনজার গ্রামে। তাতে হত্যার শিকার হয় নারী ও শিশুসহ তিন শতাধিক মানুষ। নাদিয়ার চোখের সামনে হত্যার শিকার হন তার ছয় ভাই। তাদের অপরাধ ছিল, তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে রাজি হননি। নাদিয়ার মাকেও হত্যা করা হয়। আর সেই দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয় তাকে। ওই হামলার পর যারা জীবিত ছিলেন তাদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় আইএসের ঘাঁটি মসুলে। তাদের মধ্যে ছিলেন নাদিয়াও। তিন মাস ধরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। তার মতো আরো অনেক ইয়াজিদি, খৃস্টান ও অন্যান্য অমুসলিমদেরও বন্দি করে রেখেছিল আইএস সদস্যরা। ওই তিন মাসে কেবল বন্দিত্বই নয়, যৌনদাসত্বের শিকার হতে হয় নাদিয়াকে। তাকে নির্যাতন করা হয়, ধর্ষণ করা হয়। তার মতো এমন কুৎসিত নির্যাতনের শিকার হন আরো পাঁচ হাজারেরও বেশি ইয়াজিদি নারী। এখনও প্রায় ৩,৪০০ ইয়াজিদি নারী ও শিশু বন্দি রয়েছে আইএসের হাতে। প্রায় দুই বছর পর নাদিয়াকে মানবপাচারের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষদের দুর্দশার বিষয়ে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে জাতিসংঘ তাকে নিযুক্ত করে শুভেচ্ছাদূত হিসেবে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেন, নাদিয়ার ‘শক্তিমত্তা, সাহস ও সম্ভ্রমে’র পাশাপাশি তার দুর্ভাগ্য দেখে তিনি ‘কান্নায় ভেঙে পড়েছেন’। নাদিয়া নিজেও একঘেয়ে কণ্ঠে ও কোনো ধরনের আবেগ প্রদর্শন না করে জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেন তার বন্দিত্বের সময়কার দুর্দশার কথা। তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে অপমান আর অব্যাহত সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে এবং আরো দেড়শ’ ইয়াজিদি পরিবারকে। নাদিয়া বলেন, ‘আমি একা ছিলাম না এবং সম্ভবত আমিই ছিলাম সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। একটা সময় আমি পালিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু আরো হাজারও নারী তা পারেনি। তারা এখনও বন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। আমি এখানে সেইসব নারীদেরই প্রতিনিধিত্ব করছি যাদের আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের আমরা ফেরত আনতে পারি না। তাদের স্মৃতি স্মরণ করেই আমাদের লড়াই চালিয়ে যাবো।’ নাদিয়া জানান, বন্দিদশার অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক নারীই নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। তিনি তা করেননি। টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেন, ‘আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিতে চাইনি। বরং আমি চেয়েছি তারা যেন আমাকে হত্যা করে।’ তিনি জানান, বন্দিদশার তিনদিনের মাথায় তাকে একজন আইএস সদস্যের হাতে তুলে দেয়া হয় উপহার হিসেবে। ওই আইএস সদস্য তাকে নিগৃহীত করেছে এবং নির্যাতন করেছে প্রতিদিন। প্রথমবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়ে যাওয়ার পর তাকে দেয়া হয় কঠিন শাস্তি। তাকে একটি ঘরে রেখে নগ্ন হতে বাধ্য করা হয়। ওই ঘরের পাহারাদাররা জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। তিন মাসের চূড়ান্ত নির্যাতনের পর নাদিয়া পালাতে সক্ষম হন। তখন থেকেই তিনি অবস্থান করছেন জার্মানিতে এবং ইয়াজিদিদের ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিগোচর করতে কাজ করে যাচ্ছেন। আইনজীবী আমাল আলামউদ্দিন ক্লুনির সহায়তায় নাদিয়া আইএসকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিতে চান। নাদিয়াকে জাতিসংঘের বিশেষ দূত নিযুক্ত করার প্রেক্ষিতে আমাল ক্লুনি বলেন, ‘আমি খুশি হতাম যদি বলতে পারতাম যে আমি এখানে থাকতে পেরে গর্বিত। কিন্তু আমি তা নই।’ গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের প্রায়শ ব্যর্থতা বা এর জন্য দায়ীদের শাস্তির আওতায় না আনতে পারাকে লজ্জাজনক মনে করেন তিনি। নাদিয়ার মতো মেয়েদের যেভাবে পণ্য হিসেবে এবং যুদ্ধের ময়দানে যেভাবে তাদের শরীরকে ব্যবহার করা হয় তাতে তিনি লজ্জিত। আমাল ক্লুনি বলেন, ‘একজন নারী হিসেবে আমি লজ্জিত। আমি লজ্জিত যে আমরা তাদের সহায়তার আকুল আবেদন অগ্রাহ্য করেছি।’ নাদিয়ার ইয়াজিদি বোনদের যেভাবে বন্দি করে রেখেছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন নাদিয়া মুরাদ। এ জন্য তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সফরও করছেন। তিনি দেখা করেছেন মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং গ্রিস প্রেসিডেন্ট প্রোকোপিস পাভলোপোলাসের সঙ্গে। অ্যাথেন্সের এক অনুষ্ঠাতে আগত দর্শকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি আমার উদ্বেগ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জানানোর চেষ্টা করেছি। আমি জানাতে চেয়েছি যে হাজার হাজার নারী ও শিশু এখনও বন্দিদশায় রয়েছে।’ নরওয়ে ও ইরাকেও আলোচনার জন্য বৈঠকে বসেছেন তিনি। এমন এক বৈঠকের পর নরওয়ের রাজনীতিবিদ অডান লিসবাক্কেন নাদিয়ার নাম নোবেল কমিটির কাছেও প্রস্তাব করেছেন। লিসবাক্কেন বলেন, ‘আমরা এমন একটি শান্তি পুরস্কার চাই যা যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে যৌনতার ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বকে রুখে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।’ নাদিয়াও তার কাজ করে যাচ্ছেন। আইএসের বিরুদ্ধে ভয়ডরহীনভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। তার জন্য এখনও তিনি মাঝেমাঝেই মৃত্যুর হুমকি পান। কিন্তু নাদিয়ার জন্য মৃত্যু আর কোনো ভয় নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে নারকীয় অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, তার তুলনায় মৃত্যু কিছুই নয়।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.