শুনেছি চিন দেশের লি নদীর জলে নাকি চাঁদনি রাতে পরীরা এসে সময় কাটায়! পৃথিবীতে সত্যি-ই তা হলে এত সুন্দর জায়গা আছে, যেখানে পরীরা তাদের জগত্ ছেড়ে ঘুরতে আসে! উত্তর জানতে চিনের ভিসা নিয়ে ক’দিনের ছুটিতে শুভ্রনীলের সঙ্গে গেলাম সেই স্বপ্নরাজ্যে। নাম তার ইয়াংশু। স্বপ্নই বটে! ঘন সবুজ কার্স্ট মাউন্টেনের জালে বাধা পড়া এক ফালি জায়গা, আর তার বুক চিরে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের ধারা— লি নদী। শুভ্রনীল আর আমি কাজের সূত্রে ছিলাম হং কং-এ। অনেক দিন ধরেই ইচ্ছে গুইলিন যাওয়ার। চিনারা একে বলেন ‘হেভেন আন্ডার দ্য স্কাই’। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম, পর্যটকদের ভিড়ে গুইলিন অনেক বেশি বাণিজ্যিক। তবে এখান থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের এক পাহাড়ি শহর ইয়াংশু-তে নাকি স্বর্গের খোঁজ মিলতে পারে! আমরা আগে থেকে চিনা রেলের সফট স্লিপারের টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। ট্রেনের পাশাপাশি বহু স্লিপার বাসও আছে, যেগুলো সরাসরি ইয়াংশু যায়। গুইলিনে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে। হং কং থেকে মেট্রো রেলে চিন লাগোয়া সীমান্ত শহর শেনঝেন-এ পৌঁছলাম। সেখান থেকে সন্ধে পৌনে ছ’টায় ছাড়ল গুইলিনের ট্রেন। পর দিন ভোরে ঘুম জড়ানো চোখে দেখি ট্রেন ছুটছে সবুজের হাত ছুঁয়ে। মাথার উপরে নীল আকাশ নিয়ে দূরে গম্বুজের মতো ছোটবড় সব পাহাড়ের সারি। দৃশ্যপট বদলে গেল একটু পরেই। আকাশের নীল রঙে সোনালি আলোর খেলা। কোথাও চাষিরা মাথায় তালপাতার মস্ত বড় টুপি পরে খেতে কাজে নেমে পড়েছে। কোথাও বা আবার চারদিক একেবারে ফুলে ফুলে রঙিন। এ সবের মাঝেই ট্রেন থামল গুইলিনে। চকচকে পরিষ্কার স্টেশন চত্বর পেরিয়ে বাইরে এসে ইয়াংশু-র বাস ধরলাম।
বাস ছুটছে। এই মেঘ, এই রোদ্দুর, তো এই কুয়াশা। কখনও শরতের মিষ্টি রোদ্দুর স্নান করছে লি নদীতে। কখনও বা মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের সঙ্গে। পর মুহূর্তেই কুয়াশা ঢেকে দিল পাহাড়কে। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ চলা শেষে পৌঁছলাম স্বপ্নের সেই পাহাড়ি দেশে। পুরো শহরটাই পর্যটন শিল্পের কথা ভেবে যেন বানানো হয়েছে! তাই বোধহয় একে বলা হয় ‘ফরেনার্স ভিলেজ’। বাস স্ট্যান্ডে নেমে দেখি, চার দিকে প্রচুর পর্যটক আর গাইড। স্ট্যান্ডের ঠিক উল্টো দিকে বেশ বড় একটা পার্ক। সেখানে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক গাড়ি — দেখতে অনেকটা অটো রিকশার মতো। তবে আকারে একটু বড়। তারই একটিতে চেপে বসলাম। চালক জানালেন, ২০ ইউয়ান-এর নোটে (চিনা টাকা) যে ছবি ব্যবহার করা হয়, সেটি এই ইয়াংশু-র লি নদীর ছবি। হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে বইছে লি। নদীর ও পারে সবুজ কার্স্ট মাউন্টেনের সারি। নদীতে নামার জন্য খুব সুন্দর সিঁড়ি রয়েছে। ইচ্ছে হলেই তার ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়। হোটেলের ডান দিকের ছোট ছোট দোকানে পসরা সাজিয়ে এ দেশের মেয়ে-বৌ-রা বিক্রি করছেন পশমিনা শাল, চিনা হ্যান্ড ব্যাগ, সোয়েটার, সিল্ক স্কার্ফ, সিল্ক টাই, চিনা ছাপার ছোট বড় হাত পাখা, যা গরমের দিনে ব্যবহারের পাশাপাশি দেওয়ালে টাঙিয়ে ঘর সাজানো যায়। এ ছাড়াও বিক্রি হচ্ছে হাতের কাজের বিভিন্ন জিনিস। যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ড্রাগন আর ফেঙ শ্যুই।
দোকান দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। পড়লাম ‘ওয়েস্ট স্ট্রিট’-এ। এখানেও পর্যটকদের মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের দোকান রয়েছে। ওয়েস্ট স্ট্রিটের একদম প্রান্তে পৌঁছলাম। এ রাস্তার নাম ‘হান্ড্রেড ফুড স্ট্রিট’। ভোজনরসিকদের তৃপ্তির জন্য একশোরও বেশি রেস্তোরাঁ। তার মধ্যে ভারতীয় রেস্তোরাঁ রয়েছে। চলছেও রমরমিয়ে। তবে এ সবের পাশাপাশি রীতিমতো ঠেলাগাড়িতেও বিক্রি হচ্ছে সস্তার জনপ্রিয় খাবার। বিকেল থেকে রাত অবধি লি নদীর পাড়ে ফুটপাথে ঠেলাগাড়ি করে বিক্রি হয় স্পাইসি তোফু ফ্রাই (মশলাদার পনির ফ্রাই)। সুস্বাদু এই ফ্রাই না খেলে এখানে আসাটাই যেন বৃথা। এ ছাড়া, দুপুরবেলা গলা ভেজাতে ঠান্ডা আখের রস আর সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে আড্ডা জমাতে চিকেন বা ফিস বার-বি-কিউ-এর কোনও জুড়ি নেই। মশলা মাখিয়ে রাখা চিকেন বা ফিসের ছোট ছোট টুকরো একটি কাঠির মধ্যে গেঁথে আগুনে ফেলে ঝলসানো, তার উপর লেবু, ধনেপাতা কুচি আর অন্য মশলা ছড়ানো— জিভে জল অবধারিত। চারপাশ ঘুরে হোটেলে ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া সারতেই বেলা গড়িয়ে গেল। বিকেল থেকে সন্ধে অবধি বিভিন্ন দোকান ঘুরে, জমিয়ে কেনাকাটা করে কাটিয়ে দিলাম। কলকাতার মেয়ে বলে দর কষাকষি বেশ ভালই হল! পর দিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে জলের ঝমঝম শব্দ। বারান্দায় এসে সামনে তাকাতেই দেখলাম হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে একটু নীচে ছোট্ট এক জলপ্রপাত। সে কলকল শব্দে নেমে এসে মিশে গিয়েছে লি-র শান্ত স্রোতে। কাল এত ঘোরাঘুরির মধ্যে এটা লক্ষই করিনি! স্বপ্নটা যেন ঠিকঠাক পূর্ণ হল— নদী, ঝরনার মুক্তধারা, সবুজ পাহাড়, রঙিন ফুলের বাগিচা, শরতের রোদ্দুরমাখা নীল আকাশ, ভোরের আলোয় ভেজা গহিন অরণ্য— সব মিলিয়ে এক ছোট্ট স্বর্গরাজ্য।
শহরটা খুব একটা বড় নয়। আগ্রহ থাকলে পায়ে হেঁটেও ঘোরা যায়। তা ছাড়া, প্রচুর গাড়ি ও ছোট বাস আছে। মন চাইলে সাইকেল অথবা বাইক ভাড়া নিয়েও পাহাড়ের পথে বেড়ানো যায়। অথবা ব্যাম্বু বোটে চড়ে নদীর বুকে ভেসে যাওয়া যায় ইচ্ছেমতো। যে হেতু রূপকথার দেশ, তাই এখানকার গাড়িগুলো যেন একই রকমের গোলাপি জামা পরেছে। আসলে গাড়িগুলি মিষ্টি গোলাপি রঙের। ইয়াংশু থেকে ঠিক ছয় কিলোমিটার দূরে রয়েছে এক বিশাল বটগাছ। বহু সিনেমারও শ্যুটিংও হয়েছে এই ‘বিগ বানিয়ান ট্রি’র ছায়ায়। এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে রয়েছে ‘মুন হিল’। এমন নামের কারণ, এই পাহাড়ের মাঝখানে ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো একটা বিরাট গর্ত রয়েছে। চার দিকের পরিবেশ মনমাতানো সৌন্দর্যে ভরপুর। ‘বিগ বানিয়ান ট্রি’ এবং ‘মুন হিল’-এর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে ‘অ্যাসেম্বল্ড ড্রাগন কেভ’। চুনাপাথরের তৈরি এই গুহার ভেতর আলো-অন্ধকারে মেশানো পরিবেশ। কানে ভেসে আসে মিষ্টিমধুর এক গানের কলি। গানের সঙ্গে রঙিন নিয়ন আলোর খেলা— সব মিলিয়ে এ যেন এক মায়াবি রাজ্য।
দুপুরে খেতে গেলাম ভারতীয় রেস্তোরাঁ ‘কালি মির্চ’-এ। আলাপ হল হোটেল মালিকের সঙ্গে। তিনি দার্জিলিং থেকে সাত বছর আগে এখানে এসেছিলেন গাইড হিসেবে। বেশ কিছু বছর পর তাঁর হবু গৃহিণীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে খুলেছেন এই রেস্তোরাঁ। বান্ধবীটি চিনা নাগরিক। কীসের টানে এই ভিন্ দেশে পড়ে আছেন? শুধুই ব্যবসা না বিদেশিনি বধূ? নাকি এই মায়াবি প্রকৃতির জাল কাটিয়ে আর ফিরতে ইচ্ছে করেনি? উত্তরে তিনি শুধু হাসলেন। আলাপ হল আরও তিন রাঁধুনির সঙ্গে, এঁরা প্রত্যেকেই দার্জিলিং থেকে এসেছেন। দেশের মানুষজন, সুস্বাদু খাবার— মাটন কষা, নান, মাটন বিরিয়ানি, মিষ্টি— প্রাণ ভরে গল্প করতেই বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। পাহাড়ি মানুষদের সহজ সরল জীবনধারা ও আন্তরিকতার কথা উল্লেখ না করলে রূপকথার এই গল্পটা সম্পূর্ণ হবে না। এঁদের উদার ব্যবহার আমাদের প্রতি মুহূর্তকে আরও রঙিন করে তুলেছিল। ফিরে এসে হোটেলের বারান্দায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে লি নদীর ও পারে সূর্যাস্ত দেখার ফাঁকে কখন যে সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল, বুঝতেই পারিনি! সে দিন ছিল পূর্ণিমা। চিনে এই সময়ে এক সপ্তাহ ধরে ‘অটাম ফেস্টিভ্যাল’-এর ছুটি। এখানকার রীতি মেনে সেই রাতে ‘মুন কেক’ কিনলাম। শরতের আকাশে সহস্র তারাদের ঝিকিমিকি আর চাঁদের আলো নদীর জলে ভেসে রয়েছে। পাড়ে তখনও দু’এক জন মাঝি সওয়ার নিয়ে যাওয়ার আশায় নৌকায় টিমটিমে আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে। দূরের অন্ধকার পাহাড়ে জ্বলে উঠেছে হাজার আলোর মালা। সহস্র জোনাকি যেন একসঙ্গে তাদের সব রোশনাই উজাড় করে সাজিয়েছে শরত্-পূর্ণিমার রাতটিকে।
তৃতীয় দিন সকালে ‘ক্রুজ’ সফরে গেলাম। লি-র পাড়ে বাঁশের তৈরি ছোট ছোট নৌকা আমাদের নদীর বুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। একটার পর একটা ব্যাম্বু স্টিক পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হয়েছে এই ভেলা। ইদানীং বেশির ভাগ ভেলাই বাঁশের মতো দেখতে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে তৈরি। ভেলার উপর বসার জায়গা আর মাঝির হাতের দাঁড় কিন্তু বাঁশের তৈরি। ভেসে চলেছি। মাথার উপর নীল আকাশ। নদীর পাড় ঘেঁষে উঠে গিয়েছে পাহাড়। ‘মাঝিভাই’য়ের সঙ্গে গল্প করার ফাঁকেই লক্ষ করছি দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। নদীর পাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে আপন মনে পেন্টিং-এ ব্যস্ত। ছবি আঁকার এ এক অনবদ্য জায়গা। ঠান্ডা হাওয়া যেন ঘুমপাড়ানি গান গাইছে! এত নির্জন সুন্দর জায়গা আগে কোথাও দেখেছি কি না মনে পড়ছে না। সারি সারি পাহাড়ের এক একটি যেন এক এক আকারের। হঠাত্ একটি পাহাড় চোখে পড়ল, দেখতে একেবারে মানুষের বুড়ো আঙুলের মতো। ঈশ্বরের কী অপূর্ব সৃষ্টি! নৌকাবিহার শেষে হোটেলে ফেরার পথে দোকানপাট ছাড়িয়ে আরও খানিকটা হেঁটে পৌঁছলাম এক মনাস্ট্রিতে। গেট বন্ধ থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। নদীর পাড়ে দেখি, এক আদিবাসী বৃদ্ধ একটি বাঁশের উপর দু’টি বুনো জংলি হাঁস নিয়ে বসে আছেন। বাকি দিনটা এ দিক ও দিক ঘুরে, খাওয়াদাওয়া ও কেনাকাটা করে কেটে গেল। স্বপ্নরাজ্যে তো আর চিরকাল থাকা যায় না! তবে তাকে মনের মণিকোঠায় বন্দি করা যায়। ইয়াংশু ছেড়ে চতুর্থ দিন সকালে রওনা হলাম গুইলিনের উদ্দেশে। তার আগে মায়াবি সবুজ অরণ্যের বুনো গন্ধ প্রাণ ভরে গায়ে মেখে নিলাম। মায়া কাটিয়ে চলে যেতে মন চাইছে না। গাড়িতে মালপত্তর চাপিয়ে উঠে বসলাম। রোদ্দুরে চিকচিক করছে লি-র জল। আগের দিন দেখা সেই ঝরনাটি সূর্যের আলোয় স্নান করে তার জলধারা নিয়ে আমাদের আবার আসার নিমন্ত্রণ জানাল। বাস ছেড়ে দিল। পিছনে পড়ে রইল আমার সবুজ পাহাড়ি মিষ্টি স্বপ্নের দেশ — ইয়াংশু।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.