মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও চালকেরা ১২০ কিলোমিটারপর্যন্ত গতিতে যাত্রীবাহী বাস চালাচ্ছেন এবার ঈদে দেশের সড়ক-মহাসড়ক প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে, ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। গত ঈদুল ফিতরের সময়ও প্রতিদিন গড়ে ১৫ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান সড়ক দুর্ঘটনায়। বিশেষজ্ঞ, পুলিশ ও পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের মতে, ঈদে দুর্ঘটনার মূল কারণ অতিরিক্ত গতি। চালক-মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ বেপরোয়া যানবাহন চালাতে উৎসাহিত করে। এর ফলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গত শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাস-মাইক্রোবাসের দুর্ঘটনায় নয়জনের প্রাণহানির মূলে রয়েছে অতিরিক্ত গতি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঈদে যানবাহনের মালিক ও চালক উভয়ই অতিরিক্ত আয়ের নেশায় বিরামহীনভাবে যানবাহন পরিচালনা করেন। তবে যানজট থাকলে ট্রিপ (যাত্রা) কমে যায়। তখন ক্লান্ত চালক আয় বৃদ্ধির জন্য ফাঁকা রাস্তা পেলেই গতির ঝড় তোলেন। বাংলাদেশের সড়কের যে সক্ষমতা তাতে ৬০-৭০ কিলোমিটারের বেশি গতি তোলার সুযোগই নেই। কিন্তু চালকেরা ১০০-১২০ পর্যন্ত গতিতে যাত্রীবাহী বাস চালাচ্ছেন। এটা ধরার যন্ত্র নেই, দোষী ব্যক্তি শাস্তিও পাচ্ছেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
মোটরযান আইনে জাতীয় গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই আইন মানলে যাত্রীবাহী বাসগুলো শহর ও লোকালয়ে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা। আর মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার। সরকার চাইলে এই গতিসীমা বাড়াতে-কমাতে পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর আগস্টে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক সভায় মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই গতিবেগ মানাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ডিজেলচালিত যানবাহনে গতিসীমা বেঁধে দেওয়ার যন্ত্র (স্পিড গভর্নর) রয়েছে। সব যানবাহনের এই গতি নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বিকল। মোটরযানের ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় এই যন্ত্র চালু আছে কি না, তা দেখেই সনদ দেওয়ার কথা। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।
বেপরোয়া গতি ও মুনাফা লোভের কারণে বিরামহীন বাস পরিচালনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক। তিনি বলেন, যে সময়টায় সড়কে যানজট ছিল, সে সময় দুর্ঘটনার হার কম। আসলে মুনাফা লোভ এবং অতিরিক্ত গতিই দুর্ঘটনা বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, ঈদের আগে অতিরিক্ত ট্রিপ বন্ধে তাঁরা রাজধানীর টার্মিনালে হানা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সফল হওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় পড়া যানবাহনের মালিক ও চালককে বিআরটিএতে ডাকা হয়েছে। দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দশককে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ সময়ের মধ্যে সারা পৃথিবীতে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে এ-সংক্রান্ত নথিতে বাংলাদেশও সই করেছে। কিন্তু সরকার কয়েকটি সড়কের বাঁক সোজাকরণ ও সড়ক সম্প্রসারণ ছাড়া গতিনিয়ন্ত্রণ ও চালকদের বেপরোয়া মনোভাব রুখতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, অতিরিক্ত গতি একটা কারণ। কিন্তু মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্য ধীরগতির যান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুর্ঘটনা ঘটেছে একটা সিএনজি অটোরিকশাকে অতিক্রম (ওভারটেক) করতে গিয়েই।
সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি ঈদেই সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। তবে হতাহতের ঘটনায় তারতম্য হয়। সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে পুলিশ। তাদের তথ্য নিয়ে পূর্ণাঙ্গ হিসাব তৈরি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। তবে যেসব দুর্ঘটনায় মামলা হয়, সেগুলোই কেবল পুলিশের হিসাবের মধ্যে থাকে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা কমছে। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে ঠিক উল্টো।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে সড়ক দুর্ঘটনার সমীক্ষা করে থাকে। সংস্থাটির হিসাবে, এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৭ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৭ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩৪৬ জন। ১০টি জাতীয় দৈনিক ও ৬টি আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবরের ওপর ভিত্তি করে সংগঠনটি এই হিসাবে দিয়েছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, গত ঈদুল ফিতরে সারা দেশে ১২১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ১৮৬ জনের। আহত হন ৭৪৪ জন।
সমিতির হিসাবে, ২০১৫ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮ হাজার ১৫২ জন। পুলিশের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট এখনো গত বছরের হিসাব তৈরি করেনি। তবে তা বেসরকারি হিসাবের চার ভাগের এক ভাগ।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক মোয়াজ্জেম বলেন, গতিনিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল গতি পরিমাপের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর চালকের প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। বড় ভাই, ছোট ভাইকে এবং চালক তাঁর সহকারীকে কোনোরকম নীতিমালা ছাড়াই চালক ঘোষণা করে ছেড়ে দিচ্ছেন। লাইসেন্স-ব্যবস্থা শক্ত নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। আর সবকিছুর ওপরে আইন অমান্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকা এবং তা কার্যকর করা জরুরি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.