গ্রামে কোনো অনুষ্ঠান হলেই সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতো একটি নাম—নিতু মণ্ডল। নেচে- গেয়ে গ্রামের মানুষকে মাতিয়ে রাখত সে। সেই চঞ্চল কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ কোলে নিয়ে কাঁদতে হলো গ্রামবাসীকে। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রামের নিতু মণ্ডলকে (১৪) হত্যা করা হয়েছে কুপিয়ে। গতকাল রোববার সকালে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে খালে ফেলে রেখে যান একই গ্রামের যুবক মিলন মণ্ডল। পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে গ্রামবাসী। নিতু নবগ্রামের নির্মল মণ্ডলের মেয়ে। নবগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল সে। পুলিশ, গ্রামবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, নির্মল মণ্ডলের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নিতু বড়। ছোট ভাই দীপ্ত মণ্ডল পাশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রতিবেশী মিলন মণ্ডল তার গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি ওই গ্রামেরই মৃত বীরেন মণ্ডলের ছেলে। তিনি কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। নিতুর পরিবারের অভিযোগ, কিছুদিন যাবৎ নিতুকে উত্ত্যক্ত করছিলেন মিলন। গত ৫ আগস্ট তাকে বাড়িতে একা পেয়ে মারধরও করেন মিলন। বিষয়টি মিলনের পরিবারকে জানান নিতুর বাবা নির্মল মণ্ডল। গতকাল স্কুলে যেতে সকালে বাড়ি থেকে বের হয় নিতু। মিলনও তার পিছু নেন। বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে রাস্তায় নিতুকে কুপিয়ে পাশের একটি নালায় ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় গ্রামবাসী তাঁকে আটক করে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়। আহত অবস্থায় তাঁকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করায় পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী আশুতোষ অধিকারী বলেন, ‘মেয়েটাকে একটি ছেলে কোপাচ্ছে দেখে আমাদের বাড়ির একটি বাচ্চা মেয়ে খবর দেয়। রাস্তায় ছুটে গিয়ে দেখি নালার ভেতর উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। আর মিলন দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’ দুপুরে নবগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিতুর মৃত্যুর খবরে বিদ্যালয়ের পাঠদান কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। তার বাড়িতে শত শত মানুষের ভিড়। বাড়ির উঠানে তার মা নিপা মণ্ডল আর বাবা নির্মল মণ্ডল আহাজারি করছেন। সেখানে উপস্থিত কালকিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি কাজী নাছরিন বলেন, ‘হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আমরা রাস্তায় নামব।’ নিতুর বাবা নির্মল মণ্ডল বলেন, ‘নিতু ছিল গরিবের ঘরে চাঁদের আলো। মেয়েটি আমাকে বলত, বাবা আমি বড় ডাক্তার হব, গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দেব, আমাদের কোনো অভাব থাকবে না। এখন কে আমার অভাব দূর করবে?’ নবগ্রামের বাসিন্দা সুভাষ মণ্ডল বলেন, ‘নিতুর বাবা দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি। পড়ালেখার পাশাপাশি নিতু নাচ-গানেরও চর্চা করত। সে ছিল গ্রামের সেরা। মেয়েটির রক্তাক্ত মরদেহ নিয়ে আমাদের এভাবে কাঁদতে হবে ভাবতেও পারিনি।’ নবগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহদেব চন্দ্র বাড়ৈ বলেন, মেয়েটি মেধাবী ছিল। সে গত বছর জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। নাচ-গানে নাম ছড়িয়ে পড়ায় উপজেলা ও জেলা শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ত তার। তাকে হত্যার প্রতিবাদে সোমবার (আজ) বিদ্যালয়ের আয়োজনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। কালকিনির ডাসার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক বলেন, অভিযুক্ত মিলন মাদারীপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিতুর শরীরের পাঁচ জায়গায় ধারালো ছোরার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.