মালয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো রেস্তোরাঁর মালিকের নাম পেয়ার আহম্মদ ওরফে আকাশ। তিনি ফেনী ও নোয়াখালীতে ১১ বছর আগে দায়ের হওয়া দুটি অস্ত্র মামলার আসামি। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান থেকে খোয়া যাওয়া একটি একে-৪৭ রাইফেল বেচাকেনার অভিযোগে করা ওই মামলা দুটি থেকে জামিনে বেরিয়ে তিনি মালয়েশিয়ায় চলে যান। ওই মামলাতেই তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করেছিল। মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্য স্টার অনলাইনে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো ওই রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঢাকায় হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন এক জঙ্গির নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তবে পেয়ার আহম্মদের নিকটাত্মীয়রা কাছে দাবি করেন, তিনি জঙ্গিবাদে জড়িত নন। ফেনীর অস্ত্র মামলায় রেড নোটিশ থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিরোধের কারণে মালয়েশিয়ায় তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছেন। মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়া পুলিশ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র পাচারে যুক্ত থাকার সন্দেহে বুকিত বিনতাং এলাকার একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী বাংলাদেশের নাগরিককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল তাঁকে ধরিয়ে দিতে রেড নোটিশ জারি করেছিল। বিজ্ঞপ্তিতে মালয়েশিয়ার পুলিশ ফেরত পাঠানো ওই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি। তবে ঢাকার অভিবাসন পুলিশ সূত্র জানায়, ফেরত পাঠানো ওই ব্যক্তির নাম পেয়ার আহম্মদ। তিনি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার পূর্ব চন্দ্রপুর ইউনিয়নের নয়নপুর গ্রামে মো. ইব্রাহিমের ছেলে। তাঁকে গত ১৯ আগস্ট মালয়েশিয়ার পুলিশ আটক করে। ২ সেপ্টেম্বর রাতে মালিন্দা এয়ারের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত পাঠায়। ফেনীর দাগনভূঞা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম উদ্দিন বলেন, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশের সহযোগিতায় দাগনভূঞা থানার পুলিশ পেয়ার আহম্মদকে গ্রেপ্তার করে এবং ৩ সেপ্টেম্বর দাগনভূঞা থানায় নিয়ে আসা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ফেনীর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতে একটি অস্ত্র মামলা বিচারাধীন আছে। ৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আদালত তাঁকে ফেনী কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া তিনি নোয়াখালীরও একটি মামলার আসামি। পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে র্যাবের করা ওই মামলায় পেয়ার আহম্মদের সঙ্গে পুলিশের দুজন সার্জেন্টকেও আসামি করা হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটি ঘাটে অস্ত্র আটকের সময় সংলগ্ন কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন ওই দুই পুলিশ সার্জেন্ট। ওই অস্ত্র চালান থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল সরিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে সার্জেন্ট হেলাল ও সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে ২০০৫ সালে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই অস্ত্র বিক্রিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ফেনী ও নোয়াখালীর সুধারাম থানায় দুটি মামলা হয়। নোয়াখালীর মামলায় আসামি দুই সার্জেন্ট তখন আদালতে জবানবন্দিও দেন। তাঁদের তখন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে ২০০৭ সালে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন। তাঁরা ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার সাক্ষী ছিলেন। পরে তাঁরা চাকরি ফিরে পান। স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, পেয়ার আহম্মদ শাহীন একাডেমি নামে ফেনীর একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ওই স্কুলটি জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত। ওই স্কুলে পড়াকালে পেয়ার জামায়াতের ছাত্রসংগঠন শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে। এসএসসি পাস করার পর পেয়ার চট্টগ্রামে লেখাপড়া করেন। পেয়ার আহম্মদের মামা আবদুল কাদের বলেন, পেয়ার আহম্মদ লেখাপড়া শেষ করে চট্টগ্রামে ব্যবসা করতেন। ফেনীর মহিপালেও তাঁর মুঠোফোনের দোকান ছিল। আবদুল কাদের দাবি করেন, তাঁর ভাগনে কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাঁর ভাগনে অস্ত্র মামলায় ফেঁসে যান। পরে জামিন পেয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান। এক বাংলাদেশিকে সঙ্গে নিয়ে ‘রসনাবিলাস’ নামে রেস্তোরাঁ খোলেন। পরে ব্যবসায়িক বিরোধ হয়। এ কারণে ষড়যন্ত্র করে পেয়ার আহম্মদকে মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁর মামার দাবি। এদিকে মালয়েশিয়ার দ্যস্টার অনলাইনের গতকাল এক প্রতিবেদনে একটি সূত্রের (সূত্রের নাম বা ধরন বলা হয়নি) বরাত দিয়ে বলা হয়, মালয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো ওই রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী নিজ দেশে হামলার পরিকল্পনা করছিলেন এবং নিয়মিত এ বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। বাংলাদেশে একে-৪৭ পাচারের ঘটনায়ও তাঁর সংশ্লিষ্টতা আছে। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সন্দেহভাজন এক উগ্রপন্থী তরুণের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, যিনি ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এরপর তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যান। এ বিষয়ে ঢাকায় জানতে চাইলে ওই তরুণের বাবা গতকাল কাছে দাবি করেন, তাঁর ছেলের সঙ্গে পেয়ার আহম্মদ নামে কারও কখনো পরিচয় ছিল না। তাঁর ছেলে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস পড়তে গিয়েছিলেন। শেষ সেমিস্টারে পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। এরপর গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে মালয়েশিয়ায় গিয়ে ছেলেকে খুঁজে পাননি তিনি। পরে ছেলে তাঁকে জানায়, ফল খারাপ হওয়ায় ‘ভয়ে’ তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চলে যান। গত ডিসেম্বরে ছেলে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং এখন বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলাকারী ও নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলামের সঙ্গে ছেলের পরিচয় ছিল কি না, জানতে চাইলে এই বাবা দাবি করেন, ‘একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে বন্ধুত্ব হয়। ওটাই কাল হয়েছে। কিন্তু সে জঙ্গিবাদী কোনো কাজে যুক্ত ছিল না।’