নব্বইয়ের দশক বা তার আগে জন্ম নেওয়া অনেকেই শৈশবে একটা খেলা খেলতেন। বিভিন্ন কাঠি একটার ওপর আরেকটা রেখে যেকোনো একটা সরাতে বলা হতো, সব কটি না ফেলে নির্দিষ্ট কাঠিটা বের করতে পারলেই খেলায় জেতা যেত। এই খেলার আদলে মুঠোফোনের জন্য গেম তৈরি করে মো. রুবেল হামজার প্রতিষ্ঠান হামজা গেমস। নাম দেয় পিক অল স্টিক। গেমটি অ্যাপলের আইওএস অ্যাপ স্টোরের টপচার্টে রয়েছে। এমনই বেশ কিছু সফল গেম আছে প্রতিষ্ঠানটির ঝুলিতে।
গোটা পৃথিবীতে গেমের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তার সঙ্গে বাড়ছে গেম তৈরির কারিগর বা ডেভেলপার। উন্নত দেশগুলোতে উন্নত মানের ডেভেলপার থাকলেও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সফটওয়্যার প্রকৌশলী মো. রুবেল হামজা তেমনই একটি উদাহরণ। যাঁর তৈরি একটি গেম স্মার্টফোনে নামানো হয়েছে ২০ লাখ বারেরও বেশি।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের আগানগরে আবদুল কুদ্দুস ও হেনা বেগমের প্রথম সন্তান রুবেল। চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এইচএসসি পাসের পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ মেলেনি তাঁর। এরপর ভর্তি হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। প্রযুক্তিতে নিজের আগ্রহ খুঁজে পান। শিক্ষক ও সহপাঠীদের সহযোগিতা পান। নিজের ইচ্ছাটা তো ছিলই। তাই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
অনলাইনে অভিষেক
২০০৮ সালে মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিং কাজে অভিষেক ঘটে রুবেলের। কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে বসে তৎকালীন ওডেস্ক এবং ইল্যান্স থেকে মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার ডলার আয় করতে শুরু করেন রুবেল। বাবার ইচ্ছাতেই যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব গ্রিনিচে প্রোগ্রামিং শেখার জন্য ভর্তি হন। পড়ালেখা ও নিজের খরচ জোগানোর জন্য আবার শুরু করে ফ্রিল্যান্সিং। সে সময় ইল্যান্সের মোট ১ লাখ ৪৮ হাজার প্রোগ্রামারের মধ্যে রুবেলের অবস্থান দাঁড়ায় ৫০৮ নম্বরে। পরে তাঁর সাফল্য দেখে গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওডিসির যুক্তরাজ্য শাখায় তাঁকে অফিস-প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
হামজা গেমসের যাত্রা
২০১২ সালে দেশে ফিরে আসেন রুবেল। শুরুতে অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য গেম তৈরি করলেও বিশ্বব্যাপী ভিডিও গেমের চাহিদা এবং এর লাভজনক দিক বিবেচনা করে ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে চারজন ডেভেলপারকে সঙ্গে নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান ‘হামজা গেমস’ চালু করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে চারজন ডেভেলপার কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন আরও অনেকে।
হামজা গেমসের অর্জন
স্মার্টফোনের জন্য এখন পর্যন্ত ১২০টির বেশি গেম তৈরি করেছে হামজা গেমস। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো অ্যামেজিং অ্যান্ট স্ম্যাশার, যা ২০ লাখেরও বেশিবার নামানো হয়েছে। এটি খেলা যায় আইফোনে। এ ছাড়া হাংরি ফিস, ব্রেক মি নট, পিক অল স্টিক বিভিন্ন দেশের অ্যাপ স্টোরে শীর্ষ জনপ্রিয় গেমগুলোর তালিকায় স্থান পেয়েছে। হামজা গেমসের তৈরি বেশির ভাগ গেমই প্রিমিয়াম। মানে কিনে খেলতে হয়। মূলত অ্যাপলের আইওএস অপারেটিং সিস্টেমের জন্য বেশি গেম তৈরি হয়। বাংলাদেশ থেকে গুগল প্লেস্টোরে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি না থাকায় বিনা মূল্যে প্লেস্টোরে গেম দিতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাই এখন পর্যন্ত অ্যান্ড্রয়েডের জন্য এ ধরনের বেশ কিছু গেম প্লেস্টোরে প্রকাশ করলেও বিনা মূল্যে গেম ছাড়তে নারাজ রুবেল হামজা। তিনি অবশ্য বাংলাদেশ থেকে গুগল মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতির অপেক্ষায় আছেন। এ বছরের শেষ নাগাদ আইওএস অপারেটিং সিস্টেমের জন্য প্রায় ২০টি নতুন গেম অ্যাপ স্টোরে আসবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া রুবেলের তৈরি গেমগুলো আমাজন প্ল্যাটফর্মেও পাওয়া যায়।
করতে চান অনেক কিছু
নিজের কিছু স্বপ্নের কথা জানালেন রুবেল। বললেন, ‘কার্টুন স্টুডিও করব একটা। মিনা কার্টুনের মতো শিক্ষণীয় কার্টুন বানাব। আবার ওই কার্টুনগুলোর সঙ্গে মিল রেখে গেমও বানাব।’ এ দেশের প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আশাবাদী রুবেল হামজা। তিনি মনে করেন, দেশে প্রোগ্রামিং বা প্রযুক্তি শিক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তরুণদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে রুবেলের। তিনি বলেন, ‘কী আছে আর কী নেই, তা নিয়ে অজুহাত দেখিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু করার জন্য ইচ্ছাটাই যথেষ্ট। পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করাটাই আসল।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.