ভল্টের টাকা চুরি ছাড়াও আত্মসাৎ হয়েছে গ্রাহকের আমানত, প্রমাণ পেয়েছে দেশটির দুটি তদারকি সংস্থা * গুনতে হবে ৫৮ কোটি টাকা, ৬ মাস পর গ্রাহকের আমানত আর জমা নিতে পারবে না
ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম ও দুর্নীতি এবার দেশ ছেড়ে বিদেশেও আস্তানা গেড়েছে। অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ে জড়িয়ে পড়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন যুক্তরাজ্য সোনালী ব্যাংক। শুধু ভল্ট থেকে পাউন্ড চুরি করাই নয়, সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির অতিরিক্ত অর্থও পরিশোধ করা হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। এছাড়া অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকটির কয়েকটি শাখাও।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে দেশটির এ সংক্রান্ত দুটি তদারকি সংস্থার তদন্তে। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জরিমানা করা হয়েছে ৫৫ লাখ বিট্রিশ পাউন্ড, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫৮ কোটি টাকা। শাস্তির খক্ষ শুধু এখানেই শেষ নয়, আগামী জুনের পর সোনালী ব্যাংকের অভিযুক্ত সব ক’টি শাখা গ্রাহকদের কাছ থেকে কোনো আমানতও সংগ্রহ করতে পারবে না। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এসব শাখার সব কর্মকাণ্ডকে কঠোর নজদারির মধ্যে নিয়ে এসেছে যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি বা আর্থিক আচরণের কর্তৃপক্ষ (এফসিএ) এবং প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেটরি অথরিটি বা দূরদর্শী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ (পিআরএ)।
এদিকে দেশের জন্য সম্মানহানিকর এমন ঘটনা সামাল দিতে লন্ডন ছুটে গেছেন ব্যাংকিং বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, জরিমানার একটি অংশ পরিশোধ করতে তারা সময় বেঁধে দিয়েছে। তবে এর আইনগত দিক পর্যালোচনা করে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
জানা গেছে, দেশের বাইরে গ্রাহক সেবার নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে ২০০১ সালে যুক্তরাজ্যে যাত্রা শুরু করে সোনালী ব্যাংক। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় বিপত্তি দেখা দেয়। ছোট অপরাধ থেকে বড় অপরাধে রূপ নেয় ব্যাংকের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের। বেশ কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য সরকারের উল্লেখিত তদারকি প্রতিষ্ঠান দুটি অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর একে একে ভয়াবহ সব অনিয়ম ও দুর্নীতি বেরিয়ে আসে। কয়েকটি শাখা সরাসরি অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। ব্যাংকের শাখাগুলোতে অস্বচ্ছতা সন্ধান পায়।
জানা যায়, যুক্তরাজ্যের ওল্ডহেম ব্রাঞ্চের ম্যানেজার (সাবেক) ইকবাল আহমেদ ব্যাংকের ভল্ট থেকে চুরি করেছেন ৩৪ হাজার পাউন্ড। ঘটনাটি তিনি ফিন্যান্সিয়াল রেকর্ডস কারসাজির মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও করেন। এছাড়া বিল্লাল নামের এক গ্রাহকের হিসাব থেকে তিনি অবৈধভাবে ২৩ হাজার পাউন্ড উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
পাশাপাশি বেগম আলী নামের এক মহিলাকে ‘আমানত হিসাব’ খোলার কথা বলে হাতিয়ে নেন ৬০ হাজার পাউন্ড। এসব ঘটনার বাইরে মোহাম্মদ আলী নামের এক গ্রাহককে ইউএস ডলার বন্ড ক্রয়ের নামে তার কাছ থেকে ম্যানেজার ইকবাল আহমেদ এক লাখ পাউন্ড গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রতারণামূলক ওই গ্রাহককে ১ লাখ ৯০ হাজার মূল্যের ইউএস ডলারের বন্ড ইস্যু করে।
এর মাধ্যমে তিনি পুরো এক লাখ পাউন্ড হাতিয়ে নেন। সব মিলে দেশী অর্থে প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। আর্থিক এই দুর্নীতির বিষয়টি জানানো হয় যুক্তরাজ্যের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে। নজরে আসে জরিমানা আরোপকারী এফসিএ’র।
অপর ঘটনায় দেখা গেছে, ব্যাংকে স্থানীয়ভিত্তিক পদে ‘মানি লন্ডারিং রিপোর্টিং অফিসার’ নিয়োগের জন্য পৃথকভাবে ৪ দফায় ৫০ হাজার ২৫৬ পাউন্ড (দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৬৩ লাখ টাকা) দেয়া হয় রিক্রুটিং এজেন্সিকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চারজনকে নিয়োগের জন্য এ অর্থ দেয়া হয়।
এর মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেইল হ্যাকইউল এক মাসের মাথায়, জ্যানিন্স ভ্যালি চার মাসের মাথায় এবং আফতাব পীরভাহ যোগদানের আড়াই মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে চলে যান। অথচ চুক্তি অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সিকে নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের বার্ষিক গ্রস বেতনের ২২-৩০ শতাংশ পর্যন্ত আগাম অর্থ পরিশোধ করা হয়।
এক্ষেত্রে জ্যানিন্স ভ্যালি এবং আফতাব পীরভাহ নিয়োগের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অতিক্তির অর্থ পরিশোধ করেছে ১৮ হাজার ৩শ’ পাউন্ড।
এছাড়া ৩৬ হাজার পাউন্ড দিয়ে মিসওয়াইস কেবিএস লিমিটেডের কাছ থেকে একটি সফটওয়্যার কোম্পানি লাইসেন্স ক্রয় করে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লি.। সার্ভিস গ্রহণের বিনিময়ে প্রতি তিন মাস অন্তর ওই কোম্পানিকে প্রায় ৭ হাজার ২শ’ পাউন্ড পরিশোধ করা হয়। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ব্যাংক থেকে ফি ২০ শতাংশ বেশি পরিশোধ করা হয় সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রায় ৯ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তদন্তে বলা হয়েছে, এসব প্রক্রিয়া সবই অনিয়ম-দুর্নীতির অংশ।
আরও জানা যায়, ৬টি শাখার টেবিল চেয়ারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই অবলোপন করা হয়েছে। যার মূল্য ১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড। তবে কি কারণে অবলোপন করা হয় তার কোনো ব্যাখ্যা ব্যাংকে পাওয়া যায়নি। অবলোপনের সময় ন্যূনতম বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া অবলোপনের আগে বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়নি এসব সরঞ্জাম।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, লন্ডনের সোনালী ব্যাংক এখন বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে উদ্বেগজনক এ বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে। তবে সংকট মোকাবেলায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। তিনি এ পরিস্থিতির আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে গত শনিবার যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
এছাড়া যুক্তরাজ্যের সোনালী ব্যাংকের জরিমানা ও অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে। সেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক আর্থিক আচরণে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এফসিএ এবং পিআরএ যুক্তরাজ্যের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর কঠোর আচরণ করছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্য বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। এই অবস্থা সরকারিভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংলাপ শুরু করা যেতে পারে। এতে ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনতে পারে।
প্রসঙ্গত, সরকার ও সোনালী ব্যাংকের যৌথ মালিকানায় ২০০১ সালে যুক্তরাজ্যে স্থাপন করে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লি.। একটি স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসাবে যুক্তরাজ্যের আইন ও বিধিবিধানের আওতায় এটি পরিচালিত হচ্ছে। এই ব্যাংকের ৫১ শতাংশের মালিক সরকার এবং বাকি ৪৯ শতাংশ হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের।
পদাধিকারবলে এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান।
তিনি যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, সোনালী ব্যাংককে (ইউকে) জরিমানার ব্যাপারে এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। কারণ বিষয়টি যুক্তরাজ্যে আইনি প্রক্রিয়াধীন। তিনি আরও বলেন, ইউকেস্থ সোনালী ব্যাংকের সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে তিনি যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন। সেখানে জরিমানা আরোপের আইনগত বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হবে।
সোনালী ব্যাংক (ইউকে) সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা এফসিএ ও পিআরএ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন এবং তাদের পদক্ষেপ নিয়ে সম্প্রতি ব্যাংকের বোর্ড সভায় আলোচনা হয়। সেখানে লন্ডনের একটি ল’ ফার্মের আইনজীবী গ্রেজকে উপস্থিত রাখা হয়। ওই আইনজীবীর মতে, এফসিএ কর্তৃক আরোপিত দণ্ডের (জরিমানা) বিরুদ্ধে আপিল করে পুরো মওকুফ পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
ওই আইনজীবী মনে করেন, শেষ পর্যন্ত এই জরিমানা সোনালী ব্যাংককে পরিশোধ করতে হবে। আর প্রকারান্তরে সে অর্থ বাংলাদেশের জনগণের দেয়া ট্যাক্সের টাকা থেকেই যাবে।
এদিকে ব্যাংকটির আর্থিক কেলেংকারির এখানেই শেষ নয়, ঢাকাস্থ দূতাবাস অডিট অধিদফতর নিরীক্ষা করে প্রায় ১৬ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। সোনালী ব্যাংকের (ইউকে) কয়েকটি শাখার ২০১৩-১৫ অর্থবছরের নথিপত্র যাচাই-বাছাই করলে এ অনিয়ম বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি রিপোর্টটি জমা দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব (ভারপ্রাপ্ত) ফজলুল হক রোববার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস অডিট রিপোর্টের বিষয়টি এখনও তার নজরে আনেনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.