মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব শেষ করতে চলেছেন বারাক ওবামা। পর পর দুই দফায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদে আসীন ছিলেন। চলে যাওয়ার আগে অনেক কিছুই বলতে চান তিনি। সম্প্রতি হোয়াইট হাউজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল হিস্টোরিয়ান ডোরিস কিয়ার্নসকে। এ সাক্ষাতের আয়োজন করে ভ্যানিটি ফেয়ার। দুজন বসেছিলেন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ডাইনিং রুমে।
ডোরিস এ কাজে নতুন নন। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে এখানে তার যাওয়া-আসা। মাত্র ২৪ বছর বয়সে হোয়াইট হাউজের ফেলো হিসাবে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করেছেন। পুলিৎজারসহ বেশ কয়েকটি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। অনেক প্রিসিডেন্টকে নিয়ে তার লেখা বই ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ।
২০০৭ সালের বসন্তে গুডউইন একটি ফোন পান ইলিনয়েসের এক তরুণ সিনেটরের কাছ থেকে। গুডউইনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন সেই সিনেটর। কারণ রাজনীতিবিদ সবে ‘টিম অব রাইভালস’ বইটি পড়া শেষ করেছেন। সেই ফোনকল বন্ধুত্বে রূপ নেয়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ওবামা তার বন্ধুপ্রতীম গুডউইনকে বিশেষ উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করতেন।
দুজনের এই চৌম্বক আলাপচারিতায় একে অপরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাক্য সম্পন্ন করেছেন। তারা কৌতুকের ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে হাওয়াই দ্বীপে সার্ফিং নিয়েও আলোচনা করেন। দুজন মুখোমুখি বসেছিলেন। কফি, পানি আর স্কোন খেতে খেতে মেতে ওঠেন আড্ডায়। বিদায়ের আগে হয়তো আর বসবেন না ওবামা। দুজনের কথোপকথন হয়ে গেছে আরেক ইতিহাস।
গুডউইন : আজ থেকে নয় বছর আগে আমাকে প্রথম কল দেন আপনি। বলছিলেন, ‘হ্যালো, আমি বারাক ওমাবা। আমি মাত্র টিম অব রাইভালস পড়েছি। এ নিয়ে কথা বলতে হবে। আমি লিঙ্কনকে নিয়ে কথা বলবো’। তাকে নিয়ে কোন বিষয়টি আপনাকে বলতে বাধ্য করেছে যে, ‘এই মানুষটাকে আমি পছন্দ করি?’
ওবামা : আমি এসেছি ইলিনয়েস থেকে। আমি স্প্রিংফিল্ডে ৮ বছর কাটিয়েছি। আমার রাজনীতির প্রথম দিনগুলোতে লিঙ্কনের প্রতি আবেগ ছিল। আমার বিশ্বাস, আমেরিকার আত্মার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো কেউ নেই। এটা কেবল এমন মানুষের প্রতি নয় যিনি নিঃস্ব থেকে উঠে এসেছেন। আত্মশিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সীমান্ত রক্ষা করেছেন। তিনি এমন মানুষ ছিলেন যিনি নিজ হাতে কাজ করেছেন, পরে মনের ব্যবহারে করেছেন। একসময় ইংলিশ ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের সারিতে চলে আসেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা মানবতাকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পারেন, মৌলিক সমস্যা নিয়ে আমেরিকার গবেষণা এবং শেষ পর্যন্ত আশাবাদ ধরে রাখার বিষয়টি সম্মানজনক। এক ভয়াবহ যুদ্ধের মাঝে মারাত্মক সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়েও ক্ষমাশীল আত্মা বহন করে চলে আমেরিকা।
আমি লিঙ্কনকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়ে যেতে পারি। তিনি অন্য কয়েকজন মানুষের মতোই। তিনি গান্ধী, পিকাসো কিংবা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়নের মতোই।
গুডউইন : মাত্র ২৩ বছর বয়সে লিঙ্কন প্রথমবারের মতো তার অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের নাকি এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা থাকে। এক যুগ পর তিনি বিষণ্ন পরিস্থিতির শিকার হন। তার অফিস থেকে চাকু, রেজর বা অন্যান্য ভয়ংকর জিনিস চুরি হতে থাকলো। তখন তিনি বলতেন, আমি যে বেঁচেছিলাম, মানুষের মনে রাখার মতো কিছু না করতে পারলে আমি মরতে প্রস্তুত। এটা কি অদ্ভুত বিষয় না? তার মনে এমনি কি হয়েছিল তখন?
ওবামা : আব্রাহাম লিঙ্কনের যেকোনো কথার সংশোধনী আনাটা খুবই মারাত্মক বিষয়। আমার মনে হয়, যখন আপনার বয়স কম তখন আকাঙ্ক্ষাগুলো কোনো না কোনভাবে একই ধরনের। আপনি তখন নিজেক প্রমাণ করতে চান। জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় যেতে পারে। আপনি প্রমাণ করতে চান যে বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের যোগ্যতা আপনার রয়েছে। আপনি প্রমাণ করতে চান যে বাবার অবর্তমানে তার মূল্য নিজে পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে আপনার। আপনি প্রমাণ করতে চান যে আপনার চেয়ে ক্ষমতাশালী প্রতিবেশীরদের মতোই সামাজিক সম্মান পেতে পারেন আপনি। তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষাগুলোর মধ্যে পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চলে আসে সাধারণভাবে। এদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ তার লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে সরে আসেন। আমার মনে হয়, যখন বায়স বাড়ে তখনই আপনার আকাঙ্ক্ষা অদ্ভুত হতে থাকে।
গুডউইন : ভালো বলেছেন। তাহলে আমরা লিঙ্কনের বিষয়গুলোকে শুধরে নিতে পারি।
ওবামা : … আমি মনে করি একটি নির্দিষ্ট স্তরে এসে আগের চাওয়াগুলো শেষ হয়ে যায়। এর কারণ হতে পারে আপনি কিছু অর্জন করেছেন, কিছু একটা করতে পেরেছেন আর কিছু অপকর্ম করেছেন। আর তখন আপনি যেমন এবং হৃদয়ের গভীরের প্রতিশ্রুতিগুলো নিজেদের প্রকাশ করতে থাকে।
আমার ক্ষেত্রে আপনিও বলতে পারেন, বাবার অনুপস্থিতিতে আমি যথেষ্ট এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা মনে পুষে রাখতাম। যিনি চলে গেছেন তার ইচ্ছা পূরণে সামর্থ্যবান থাকা প্রমাণ করতে চেয়েছি। আপনি তর্ক করতে পারেন যে, ছোটকালে আমার চারপাশে যথেষ্ট সংখ্যক কালো শিশু না থাকার কারণে আমার আকাঙ্ক্ষাগুলোর বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে এমন এক পৃথিবী প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি যেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, গোত্র ও বর্ণের মানুষ একে অন্যের সম্পর্কে জানতে পারবে। কিংবা এমন এক দুনিয়া যেখানে যেকোনো শিশু তার লক্ষ্য পূরণ করতে সমর্থ হবে।
নিজেকে প্রমাণের তাগাদাতেই সেই নির্দিষ্ট ইচ্ছাগুলো যে শেষ হয় তাই নয়, পৃথিবী সম্পর্কে বিশেষ ধারণা সৃষ্টির কারণেও ঘটে থাকে। পৃথিবীটা তখন অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে কেবল এটা আমাকে একটা জীবন ও ইতিহাস দিয়েছে বলে।
গুডউইন : এবং বিভিন্ন দিক থেকে রাজনীতি আপনার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যম হয়ে ওঠে, তাই না?
ওবামা : ঠিক তাই।
গুডউইন : তরুণ ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে খুব সাধারণ মানুষ বলেই মনে হতো। ২৮ বছর বয়সে তিনি একটি আইনী সংস্থার ক্লার্ক ছিলেন। কলেজ বা আইনের স্কুলে বিশেষ কিছু করেননি। ক্যাম্পেইনের সময় তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ কোনোভাবে পেয়ে যান। উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন, ওই সময় তার মনের কণ্ঠ বলে ওঠে যে, এটাই আমি। আর তখনই রুজভেল্ট বুঝতে পারেন তিনি কি হতে চান?
ওবামা : আমি যা বলতে চাইছি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে রুজভেল্ট। তার জীবনের প্রথম দিকের কথা চিন্তা করলে দেখতে পাবেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার খাতিরে তার মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়।
গুডউইন : একেবারে ঠিক।
ওবামা : তিনি তার ক্ষমতার ব্যবহারে কি করতে চেয়েছিলেন তা কোনো অর্থ বহন করে না। তিনি কেবল ক্ষমতা চেয়েছিলেন। তিনি কেবল বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তার ক্ষুধা ছিল, ঠিক না?
গুডউইন : কারণগুলোর এক অংশ হতে পারে ‘টেডি রুজভেল্ট…’
ওবামা : একেবারে ঠিক।
গুডউইন : তার দূর সম্পর্কের কাজিন এবং ইলানর রুজভেল্টের আঙ্কেল টেডি এটা করেছিল। বিষয়টি ছিল এমন যে, আমি ২৫ বছর বয়সে এটা করবো, ৩০ বছর বয়সে ওটা করবো, আমি প্রেসিডেন্ট হবো। তিনি এটা বলেন ২৮ বছর বয়সে। কিন্তু তার অভ্যন্তরে…
ওবামা : এর পেছনে তার মাও ছিলেন, ঠিক না? যিনি এসব পরিকল্পনা প্রথম দিনটি থেকে প্রদান করতে থাকেন…
গুডউইন : ‘তুমিও সেরা, তুমিও এ পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু’।
ওবামা : ‘তুমি এ পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু’ এবং ওটাই ছিল সবকিছু। এরপর তার পোলিও হলো। এরপর হঠাৎ ব্যক্তিগত সমস্যা এবং দেশের চলমান ঘটনার মধ্যে বাজে অবস্থার সৃষ্টি হলো। তার ভেতরের কিছু জিনিস ভালো ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রবাহমান কাজে না লাগা আবেগ যে উপায়ে বিস্ফোরিত হয়…
গুডইউন : এবং সহমর্মিতা।
ওবামা : আর সহজাত আশাবাদ যা প্রথমদিকে বিকশিত ছিল তা ধৃষ্টতার সঙ্গে ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়।
গুডউইন : বিদ্বেষপূর্ণ বাজে পরিবেশ প্রায় সব প্রেসিডেন্টকে বদলে দিয়েছে, আমার গবেষণায় দেখেছি। টেডি রুজভেল্ট ১৮৮৪ সালে তার স্ত্রী ও মাকে হারান একই দিনে। তিনি নিরবে সরে যান। আর একদিন হঠাৎ করেই মানুষের মাঝে ফিরে আসেন। টেডি এবং ফ্রাঙ্কলিন দুজনই তাদের সুবিধাভোগী স্তরকে ছাড়িয়ে যান। সে সময় তারা নিজেদের মাঝে মানবতার কিছু অর্থ খুঁজে পান। অন্যের জীবনকে আরো ভালো করতে চান। তবে তাদের ভাগ্য তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।
ওবামা : ঠিক বলেছেন। এমন কোনো উপায় থাকে যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন আপনি। আমার রাজনৈতিক জীবন থেকে তা দেখেছি। একই বিষয় অন্য কয়েকজন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটা সময় আত্মগর্ব চলে যায়। তখন নিজেকে যেখানে দেখতে চান সেখানে খুঁজে পাবেন। ক্ষমতার ব্যবহার ঘটাতে পারবেন। আমার ক্ষেত্রে তা বেশ দ্রুত ঘটেছে। এই অদ্ভুত সুবিধা পাওয়ার পর আমি কিভাবে এর যোগ্য হয়ে উঠতে পারি? এর মধ্য দিয়ে না গেলে সমস্যা পড়তে থাকবেন। তখন আপনি আরো বেশি ক্ষমতা আর মনোযোগ কাড়তে চাইবেন।
গুডউইন : এই তৃষ্ণা অদম্য।
ওবামা : এই তৃষ্ণা অদম্য। নিক্সনের মতো এক মেধাবী মানুষ যার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রথমে রুজভেল্ট বা জনসনের মতোই ছিল। কিন্তু ওই তৃষ্ণা সব পাল্টে দেয়। তখন থেকে আপনি সিদ্ধান্ত একাই নিতে থাকবেন।
গুডইউন : তাহলে এখানেই মেজাজ-মর্জির বিষয়টি আসে। আপনি নিজের সহনশীলতার বিষয়টি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন বা এটা আপনার অফিসের জন্য কিভাবে মানানসই?
ওবামা : আমি মানানসই কিনা তা খুঁজে বের করবেন ইতিহাসবিদরা। তবে বলা যায়, আমার সহনশীলতা ভারসাম্যপূর্ণ।
গুডউইন : আপনি নিজেকে কি বহির্মুখী মনে করেন?
ওবামা : না। সফল রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই যেভাবে অন্তর্মুখী, আমি তেমন নই। তবে আমি রুজভেল্ট বা ক্লিনটন নই যারা ক্রমাগত…
গুডউইন : যাদের সব সময় কাউকে কাউকে প্রয়োজন পড়ে।
ওবামা : কোনো মানুষের ভীড়কে বুঝে শুনে আমি সেখানেই নিজের সময় ব্যয় করতে পছন্দ করি। এক সময় আমার মধ্যে লেখকের স্পর্শকাতর মন ছিল। সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে আনি। আমি নিজেকে আশাবাদী মনে করি। আমি ট্র্যাজেডি বা কৌতুক সবই অনুভব করি।
গুডউইন : এই গুণ নিয়ে জন্ম নেয় মানুষ। আশাবাদ এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি যা সবকিছুর মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
ওবামা : বিষয়টি আমেরিকার মানুষ ও ইতিহাসবিদদের ওপর নির্ভর করে। আমি বলতে পারি অফিসে কোন বিষয়টা আমাকে ভালো কিছু দেয়। আশাবাদের মৌলিক বিষয়টা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন করে আপনাকে।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম দিকে আমি কায়রো যায় মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বক্তব্য দিতে। ওই দিন দুপুরে হেলিকপ্টারে করে পিরামিড দেখতে যাই। তারা আমাদের জন্য পিরামিড খালি করে দেয়। এই পিরামিড বা স্ফিংক্স জীবনের প্রতি আসক্তি আনে। এই বিষয়গুলোর বয়ান খুব কঠিন বিষয়।
আমি বিষয়টি ভুলিনি। কারণ নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দীর্ঘ সময় ভেবে আমি সময় কাটাইনি। পিরামিড যারা বানিয়েছিল তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো। এখন মানুষ সংবাদপত্র এবং টুইটার এবং টেলিভশনের মাধ্যমে তাদের জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরে।এ সবই ধুলো হয়ে যাবে। কিন্তু সেই পিরামিডের কথা এখনো মানুষ মনে রেখেছে।
এখন আমরা আমেরিকা গড়ে তুলছি। আমরা কেবল পিরামিড বানাচ্ছি না। আমরা একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলছি যেখানে মানুষ একসঙ্গে বাস করার পরিবেশ পাবে। যেখানে সব মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে।
গুডউইন : প্রেসিডেন্টের সহনশীলতার গুরুত্ব বিষয়ে যখন চিন্তা করবেন, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কিভাবে ভাববেন?
ওবামা : আমি ট্রাম্পের আচরণকে কয়েক ধরনের ভীতি, কিছু অসন্তুষ্টির প্রকাশ বলে মনে করি। আমেরিকার ইতিহাসে এ বিষয়টি তাড়া করে ফেরে।
গুডউইন : টেডি রুজভেল্ট লিখেছিলেন যে, তার আশপাশে বেশ কিছু প্রতিভাবান রয়েছেন যার মধ্যে তিনি একজন নন। কিন্তু লিঙ্কন ছিলেন একজন। কিটস যে কবিতা লিখতে পারতেন যা কেউ লিখতে পারতেন না।
ওবামা : আমি সে ক্যাটাগরিতে পড়ি না। আমি জীবনে যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু করেছি তখন তা অনেক মানুষের কারণেই করতে পেরেছি। এদের কেউ কৃতিত্ব পান, আবার কেউ পান না।
গুডউইন : জনসন তার দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলতেন। বলতেন, এটাই এক মহান সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। হামাগুড়ি থেকে হাঁটা এবং দৌড়াতে শিখিয়েছে।
ওবামা : আমি একে রিলে রেসের মতো মনে করি। আমি পরবর্তী প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আশা করবো যে তিনি বলছেন, এটা দারুণ এক শুরু। কিছু বাড়তি বিষয় রয়েছে যা আমাদের করা উচিত কিংবা উচিত নয়। প্রাথমিক অবস্থা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে নিজেদের কিছুটা উন্নত করতে পারবো।
গুডউইন : ফ্রেব্রুয়ারিতে আপনি স্প্রিংফিল্ডে আবেগপ্রসূত বক্তব্য দিয়েছেন। আপনার বিরোধী দলের মানুষদের স্বৈরাচার বা নির্বোধ বলাটা আপনার জন্য কঠিন। ২০১০ সালে সিনেটের সংখ্যালঘিষ্ঠদের নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেছিলেন, দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হবে আপনাকে এক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট করা। বিষয়টি কি আপনাকে অনেক সীমাবদ্ধ করে ফেলেনি?
ওবামা : না, তবে একটি বিষয় আমাকে বেশ অবাক করে। কারণ তখন আমরা অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ছিলাম। ক্লিনটনের সময় আমি রাজনৈতিকভাবে বেশ সাবধানে ছিলাম। আমি দেখেছি কিভাবে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি জাতীয় মূল্যবোধ হয়ে দাঁড়ায়। তখন নিউট গিনগ্রিচ কিভাবে তার বিপ্লপ ঘটিয়েছিলেন তা দেখেছি।
গুডউইন : ঠিক, সেখানে কিছু করার স্বাধীনতা ছিল।
ওবামা : এটা একটা রিয়েলিটি টেলিভিশন শো এর মতো যাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়। আমরা যখন চরম অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনও একটা সময়ের অস্তিত্ব ছিল যখন মানুষ উঠে দাঁড়াবে। তখনকার ঘটনা থেকে আমি যথেষ্ট শিক্ষা নিয়েছি।
গুডউইন : আপনি বলেছেন যে যেকোনো সময়ের চেয়ে আপনি এই সময় সবচেয়ে বেশি ভালো আছেন। আপনি কখনো আশা করেছেন যে আরো এক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবেন?
ওবামা : বেশ মজার প্রশ্ন। আমি আগেই বলেছি যে আমার মধ্যে লেখকের স্পর্শকাতরতা রয়েছে। এটা আমার মাঝে খুব বড় একটি বিষয়। এর প্রয়োগে আমি চিন্তা করি। একে আমি ধারণ করি। এর মাধ্যমেই আমি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই। তবে আমি জানি এভাবে আমার গ্রহণযোগ্যতা সব সময় থাকবে না। কিংবা এটি খুব বেশি দিন টিকবে না। কিন্তু আমি বলবো, আমার নাম বারাক হুসেইন ওবামা। আমি আফ্রিকান-আমেরিকান। আর আমি আমেরিকার জনগণের অধিকাংশের মতামতে পর পর দুইবার প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছি।
গুডউইন : এবং আপনি নিজের সম্পর্কে তা বলতে পারেন।
ওবামা : অনেকেই অনেক কথা শুনে যাচ্ছেন। এটা মজার বিষয়। এক কলামিস্ট ‘রেডিক্যাল ইসলাম’ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। কিছু রিপাবলিকান এ নিয়ে সমালোচনাও করেন।
সেই সমালোচনা আমি হৃদয়ে নিয়েছি। আমি তাকে বলি, আমি বিশ্বাস করি না যে আমেরিকানরা জটিল কোনো বিষয় সামলে নিতে পারবে না। আমি আমেরিকানদের চিনি। আমি তাদের অনেকের সঙ্গে মিশেছি। তাদের অনেকেই যথেষ্ট স্পর্শকাতর। তারা অনেকেই যথেষ্ট মনোযোগ দেন না। এখানে ওখানে অনেক গোলযোগ লেগে রয়েছে। কিন্তু যখন সময় হবে, তারা ফালতু জিনিসকে ঝেরে ফেলতে ছাড় দেবে না।
গুডউইন : আপনি নিজেকে নিয়ে গর্বিত, তাই না?
ওবামা : না, না, না, আমি…
গুডউইন : আমি মজা করছি।
ওবামা : আমি নিজেকে রাতের খবর তৈরির জন্য শব্দ আর দাঁত সর্বস্ব রাজনীতিবিদ বলে মনে করি না। জনপ্রিয় সংস্কৃতি আমি ভালো বুঝি। মিডিয়াগুলো প্রায়ই বলে, আপনি তো বুঝতেই পারছেন, এই বক্তব্য খুব বেশি দীর্ঘ। এটা খুব কঠিন। কিংবা বলে এর শব্দগুলো আরো বেশি উত্তেজনাকর হতে হবে।
গুডউইন : আপনি কি নিয়ে অনুতাপে ভোগেন। আপনি যা করেছেন বা আরো ভালো কিছু করতে পারতেন তা নিয়ে?
ওবামা : আমার যা করার ইচ্ছা ছিল এবং যা করেছি তার তালিকাটা অনেক দীর্ঘ।
গুডউইন : আমি বলছি না যে আপনি কিছু করতে পারেননি। কিন্তু আপনি হয়তো ভিন্নভাবে করেছেন।
ওবামা : আমি কি ভিন্নভাবে করেছি? এমনকি তালিকাটা প্রতিদিনই নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। হয়তো আমি কাজগুলো কিছুটা ভিন্নভাবে বা আরেকটু ভালোভাবে করেছি। কিছু সমস্যা রয়েছে যা নিয়ে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি। আমি যদি আরেকটু প্রতিভাবান হতে পারতাম তবে সমস্যা সমাধানে আরো সক্ষম হতে পারতাম।
২০০৯ এবং ২০১০ সালে যখন আমি চাপের মুখে পড়লাম, তখন আমি আমার প্রস্তাবগুলো আবারো পরীক্ষা করে দেখতাম। আমার বক্তব্য নিয়ে আবারো ভাবতাম। আমরা খেয়ালী ছিলাম বা আমরা খুব বেশি বিচ্ছিন্ন ছিলাম বা আমরা গসিপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম- এসব বর্ণনার সবই সত্য নয়।
গুডউইন : বয়ান এক সময় থেকে যায়। তাই না?
ওবামা : আমি বলতে পারি, যদি আমার মাঝে আব্রাহাম লিঙ্কনের মেধা বা রুজভেল্টের মন্ত্র থাকতো…
গুডউইন : কিংবা জনসনের মতো, আপনি তাদের প্রতি ডিনারে নিমন্ত্রণ করতেন।
ওবামা : কিংবা টেডি রুজভেল্টের প্রাণশক্তি থাকতো, কিংবা জনসনের মতো সূক্ষ্ম বিচারশক্তি থাকতো, তাহলে হয়তো সবই ভিন্নভাবে ঘটতো। তবে আমি যখন ইতিহাস পড়ি, তখন দেখেছি খারাপ সময়ে প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য দলের মধ্যে কি ঘটেছে। অর্থনীতি পড়তে থাকলে মানুষ প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা পেনশন হারায়, বাড়ি হারায়।
আমি চিন্তা করি, সব সময় কিছু না কিছু রয়েছে যার মাধ্যমে আমি বলতে পারি যে ভালো কিছু করেছি। আমি জনগণ কিংবা আমার সহকর্মীদের আরো বেশি কিছু দিতে পারতাম। কিন্তু এমন পরিস্থিতি খুব বেশি নেই যেখানে আমি পেছনে ফিরে বলতে পারি যে আমি আসলে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
গুডউইন : এটাই রুজভেল্ট বলতেন, আমি চিন্তা করি যে আমার সামনে সেই দিন ও সিদ্ধান্তগুলো উঠে আসবে যখন আমি নিজেকে বলতে পারবো যে, আমি আমার সেরাটা করেছি এবং এখন ঘুমাতে যাবো।
ওবামা : ঠিক তাই। এ বিষয়টি বুঝতে সিরিয়ার পরিস্থিতিকে উদাহরণ হিসাবে টানা যায়। এটি আমাকে প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে ফেরে। আমার মেয়াদকালে যা যা ঘটেছে, হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, গত ৫-৬ বছরে আমি ভিন্ন উপায় কি করতে পারতাম।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, অন্য কোনো কি উপায় ছিল যা নিয়ে আমরা চিন্তা করিনি? আমার সামনে যা এসেছে তারও আড়ালে কি এমন কিছু ছিল চার্চিল দেখতে পারতেন? এ ধরনের বিষয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমার এ চাকরিতে আপনাকে বুঝতে হবে যে, যে কাজগুলো করা সত্যিই অনেক কঠিন এবং যার সমাধান কেউ করতে পারছেন না, তাই আমার টেবিলে আসছে।
গুডউইন : কখনো এমন সময় এসেছিল যখন প্রেসিডেন্ট হিসাবে বিশেষ কিছু আপনাকে তাড়া করে ফিরতো? রুজভেল্ট প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর তার ছেলেকে বলেছিলেন, সারাজীবনে আমি একটি জিনিসকে ভয় পেয়েছি, তা হলো আগুন। মন্দা, বিস্ফোরণ বা কঠিন কোনো পরিস্থিতি যা আপনার মুখোমুখি হয় প্রায়ই?
ওবামা : সত্যি বলতে কি, না।
গুডউইন : ভয়ের সেই অনুভূতি পেয়েছিলেন রুজভেল্ট। তবে পরদিনই তিনি ঠিক হয়ে গিয়েছিলেন।
ওবামা : হোয়াইট হাউজে প্রথম দিন যখন কেউ বিছানায় গিয়ে আলো নিভিয়ে দেয়, তখন মনে হবে ‘ঈশ্বরই জানেন…’।
গুডউইন : ‘এটা আমি এবং আমি এখানে’।
ওবামা : ঠিক, মনে হবে, আমাকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেখানে কিছু জট পাকানো অনুভূতি আসবে। কিছু সময় আসতো যখন মনে হতো, আমি হয়তো সেরা সিদ্ধান্তটা নিতে পারবো না। আফগানিস্তান বিষয়ে প্রথম সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেখানে বাড়তি ট্রুপ দিতে হবে। কারণ পরিস্থিতি অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। ওয়েস্ট পয়েন্টে আমাকে তরুণদের মাঝে বলতে হয়েছিল, সেখানে বেশ কয়েকজনকে পাঠানো হবে এবং তাদের প্রত্যেকে ফিরে আসবে না। এসব বলা মোটেও সহজ নয়।
এটা ভীতি নয়, আরো অন্য ধরনের অনুভূতি। এটা সিদ্ধান্তের ওজন চাপার অনুভূতি।
গুডউইন : এই ওজন যখন সরে যাবে তখন কেমন লাগবে? গত আট বছরে যা করতে পারেননি তখন কি করতে পারবেন?
ওবামা : আশা করছি আমি একটু হাঁটতে বের হবো। আর…
গুডউইন : যেকোন স্থানে, তবে সঙ্গে শুধু থাকবে না…
ওবামা : হ্যাঁ, চিফ অব স্টাফ এবং আমার দলবল আর কুকুরকে নিয়ে কেবল দক্ষিণ উঠানের এদিক ওদিক নয়।
গুডউইন : বেশ মজার একটি ভিডিও’তে আপনাকে দেখ যায় সিনফিল্ডের সঙ্গে।
ওবামা : আমি অন্তত খোলা রাস্তায় যেকোনো জায়গায় একটু যেতে পারছি তাই দেখতে চেয়েছিলাম।
গুডউইন : মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগে করতে চেয়েছিলেন?
ওবামা : হ্যাঁ।
গুডউইন : আপনি কি জানেন যে, অন্যরাও করতে পেরেছিল? রুজভেল্ট একবার চার্চিলকে নিয়ে হাইড পার্কের পাহাড়ের কিনারা দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিলেন। চার্চিল খুব ভীত হয়ে পড়েছিলেন। আগের প্রেসিডেন্টরা এমন করতে পারতেন। হয়তো পরিস্থিতি অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
ওবামা : আসলে ঠিক তাই। সন্ত্রাসবাদের কারণে জরুরি অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে সবকিছুই কঠিন হয়ে গেছে। আশা করছি এ পরিস্থিতি আবারো শিথিল হবে আমি চলে যাওয়ার পর।
আমি যখন এ দায়িত্ব ছাড়বো তখন বয়স হবে ৫৫। সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু হবে আমার। আমি এমন এক প্লাটফর্ম নিয়ে কাজ করবো যেখানে ভবিষ্যত নেতারা ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজের শিক্ষা পাবে।
গুডউইন : আপনি যা করতে চান তার ভিত্তি গড়ার উপকরণ পেয়ে গেছেন। কিন্তু একে ছাড়া আপনি মানুষকে ছাড়িয়েও অন্য কিছু হয়ে যাবেন।
ওবামা : এটা আশাবাদ। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, ভবিষ্যত প্রজন্ম যখন এগিয়ে যাবে তখন আমি নস্টালজিয়াল ভুগবো।
গুডউইন : এদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবেন।
ওবামা : একটা দল আপনি এখানে গড় তুলেছেন। পরিবার আপনি গড়েছেন। জর্জ ওয়াশিংটন শীর্ষস্থানীয় তিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে সব সময় প্রথমে থাকবেন একটি কারণে। কোনো প্রতাপশালী মিলিটারি নেতা হওয়ার কারণে নয়। এটা নীতি নির্ধারণে তার অনন্য কৌশল আবিষ্কারের জন্য নয়। কারণটি হলো, তিনি জানতেন কখন চলে যেতে হবে।
গুডউইন : কিছু বিষয় আছে আপনি খুব মিস করবেন, আমি নিশ্চিত।
ওবামা : আমি এয়ার ফোর্স ওয়ানকে মিস করবো। আমি ম্যারিন ওয়ানকে মিস করবো।
গুডউইন : এ গল্পটি মনে হয় আপনাকে বলেছিলাম। আইজেনহাওয়ার ব্যক্তিগতভাবে বহু দিন কোনো ফোন কল কেননি। তবে একদিন হঠাৎ করেই ফোন কানে নিলেন এবং কিছু যান্ত্রিক আওয়াজ শুনলেন। বললেন, এই শব্দ কিসের? কেউ একজন উত্তর দিল, এটা ডায়াল টোন মিস্টার প্রেসিডেন্ট।
ওবামা : আমি এটা বলবো যে, দুটো টিনেজ মেয়ের বাবা হয়ে, আইকির (আইজেনহাওয়ার) চেয়ে বেশিই প্রযুক্তিতে আসক্ত। সূত্র : ভেনিটি ফেয়ার
– See more at: http://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2016/09/25/409218#sthash.XmgE3QRV.dpuf
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.