আমি ঢাকায় ছিলাম। যার অর্থ আমি যানজটে আটকা ছিলাম। এ বাক্যটিকে উল্টো করে লিখলেই বরং বেশি মানানসই হবে। আমি যানজটে আটকা ছিলাম, অর্থাৎ আমি ঢাকায় ছিলাম। বাংলাদেশের রাজধানীতে যদি কিছুদিন থাকেন আপনি, ‘ট্রাফিক’ শব্দটি নতুন করে ধরা দেবে আপনার কাছে। সংজ্ঞাই পাল্টে যাবে। অন্যান্য শহরেও রাস্তায় গাড়িঘোড়া আর পথচারী আছে। মাঝে মাঝে এসব রাস্তাও আটকে যায়। অগ্রগতিতে বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু ঢাকার পরিস্থিতিই যেন আলাদা। ঢাকার ট্রাফিক হলো চরম মাত্রার। এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এত ব্যাপক আর স্থায়ী যে, এটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরের নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র; এক ঝড়, যা কখনোই থামে না। ঢাকাইয়ারা আপনাকে বলবে বাকি দুনিয়ার কেউই ট্রাফিক কী তা বোঝে না। তারা আরো বলবে মুম্বই, কায়রো বা লস অ্যাঞ্জেলসের সবচেয়ে খারাপ যানজট ঢাকার চালকদের জন্য একটি ভালো দিনের সমান। বিশেষজ্ঞরা এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত। ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক জীবনমান প্রতিবেদন অর্থাৎ বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। ঢাকার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে শুধু লাগোস, ত্রিপোলি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্ক। ঢাকার পরিকাঠামো মান এই ১৪০টি শহরের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট। উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির মতো, ঢাকা একাধারে উদীয়মান আর জীর্ণশীর্ণ এক শহর। এখানকার রিয়েল এস্টেট বাজার বেশ রমরমা। মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। জীবন্ত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনধারাকে গ্রাস করেছে বাড়তে থাকা বহু দুর্দশা, যেমন- দারিদ্র্য, দূষণ, রোগ, রাজনৈতিক দুর্নীতি, চরম সহিংসতা ও সন্ত্রাসী হামলা। কিন্তু ঢাকার যানজটই শিক্ষাবিদ আর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাছে শহরটিকে একুশ শতকের নাগরিক নিশ্চলতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে। এটিই দুনিয়ার সবচেয়ে ভগ্ন শহর। এই যানজট ঢাকাকে পরিণত করেছে পরাবাস্তব এক নগরীতে। এ শহর গতিশীল, শক্তিদীপ্ত; আবার পঙ্গু। ১ কোটি ৭৫ লাখেরও বেশি বাসিন্দার দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ পাল্টে দিয়েছে যানজট। বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢাকাভিত্তিক ডেইলি স্টার পত্রিকা একটি নিবন্ধ ছাপে, যার শিরোনাম ছিল: ‘যানজটে আটকা পড়লে যে ৫টি জিনিস করতে পারেন’। নিবন্ধে যেসব কাজকর্ম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তাতে আছে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, পড়াশোনা করা, রোজনামচা লেখা, ইত্যাদি। আমার নিজের ঢাকা রোজনামচার প্রথম অধ্যায়ের শুরু হয় গত বছরের মার্চে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সোজা শহরের কেন্দ্রে চলে গেছে যে মহাসড়ক, সেটায় বসেই সবকিছুর শুরু। আপনি নেটে এই সড়ক নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলে একটি ফেসবুক পেজ চোখে পড়তে পারে। ওই পেজের নাম: ‘নরকগামী মহাসড়ক, বিমানবন্দর রোড’। অনলাইনে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যাবে এই নরকের বৈশিষ্ট্য। আকাশ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাবে বিপুল গাড়ি আঁকাবাঁকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৮ লেনের সড়কে। মনে হবে, কয়েকটি ম্যাচের বাক্স রাগী কোনো পিচ্চি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। এই ছবি দেখেই আমি সবচেয়ে খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিলাম। এরপরও ঢাকাগামী বিমানে আমাকে বলা হলো শহরে যানজট থাকবে অস্বাভাবিক রকম কম। কারণ, কয়েক সপ্তাহ ধরে হরতাল আর সড়ক অবরোধে আটকা পড়ে আছে গোটা দেশ। বিরোধী দল বিএনপির ডাকা এ হরতাল ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নতুন নির্বাচন আয়োজনে চাপ দেয়ার প্রচেষ্টা। হরতালের দরুন ঢাকার প্রতিদিনকার জীবনযাপনে বিঘ্ন ঘটে। রাজপথে বিক্ষোভ আর সহিংসতা ঢাকাবাসীকে দৈনন্দিন রুটিন সীমিত করতে বাধ্য করে। তবে এই হরতাল এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। হরতালের ফলে ঢাকার সড়কে বিশাল জট কমে যায়। বিমানে এক বাংলাদেশি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন। তার ভাষ্য, ‘ঢাকায় আপনি হয় ভয়াবহ যানজট দেখতে পাবেন, নয়তো আরো ভয়াবহ যানজট- এ দুয়ের একটি পাবেন! কিন্তু হরতাল থাকায় যান চলাচল থাকবে না বলেই চলে। ও.কে ট্রাফিক থাকবে।’ ভয়াবহ ট্রাফিক, সত্যিই ভয়াবহ ট্রাফিক, প্রায় কোনো ট্রাফিক নয়, ও.কে ট্রাফিক- ঢাকায় কয়েক মিনিটের মাথায় আপনি ধরতে পারবেন এ শব্দগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক শব্দ নয়। বিমান অবতরণের পর, আমি একটি ট্যাক্সি ধরি। কয়েকটি মোড় ঘুরে সেই কুখ্যাত মহাসড়কে নামে ট্যাক্সি। অবধারিতভাবে সেখানে যানজট ছিল। যতদূর চোখ যায় কেবল গাড়ি আর গাড়ি। এই বহরে নাক ঢুকালো আমার ক্যাব। শুরু হলো হামাগুড়ির মতো পথচলা। ২০ সেকেন্ডের জন্য সামনে এগিয়ে যায় আমার গাড়ি। এরপর আবার থেমে যায়। পরের কয়েক মিনিট আবার খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার কী এক রহস্যময় কারণে গাড়ি আবার একটু সামনে যায়। নির্বিঘ্নে কয়েক মিনিট মাঝে মাঝে চলে। এরপর এক জায়গায় এসে আবার দাঁড়িয়ে যায়। এটা অনেকটা যেন থামো-আর-চলো রুটিন, যেমনটা আমি আমেরিকায় এ রাজ্য থেকে ওই রাজ্যে যেতে দেখেছি। কিংবা একে ‘বাম্পার-টু-বাম্পার’ পরিস্থিতিও বলা যায়, যেমনটা রেডিওর রিপোর্টাররা যানজট বর্ণনা করেন। তবে ঢাকার বেলায় এটি শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনাই নয়। আদতে সমস্যাটা হলো খোদ ঢাকা। চারপাশে বেশ গরম। আমায় তখন যাত্রার ক্লান্তি ঝেঁকে ধরেছে। ঝিমুচ্ছিলাম। এক ঘণ্টা পর যখন চকিত ফিরে ফেলাম, গাড়িঘোড়া আরো জট পাকিয়েছে। আমরা তখন নগরীর কেন্দ্রে। পথচারীর সংখ্যা বাড়ছে। কাজী নজরুল ইসলাম সরণি নামে প্রশস্ত সড়কেও শত শত গাড়ি জায়গা পেতে প্রতিযোগিতা করছে। যাত্রীবাহী গাড়ি যেমন ছিল, তিন-চাকার অটোরিকশাও ছিল। বাসে যাত্রীদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা অবশিষ্ট নেই। অনেকে খোলা দরজার পাশে ঝুলে আছেন। ভ্যান নামে তিন চাকার বাহনও ছিল। বাঁশ, তরমুজ, ধাতব পাইপ, ডিম, জ্যান্ত প্রাণি নিয়ে এসব ভ্যান পাশের বাজারে যাচ্ছিল। আর হ্যাঁ, ঢাকার আইকনিক যাত্রীবাহী বাহন রিকশা তো ছিলই। সরকারিভাবে কাজী নজরুল ইসলাম সরণির মতো প্রধান প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু আমি সেগুলো দেখেছি। তাদের বেলের আওয়াজ যানজটের গর্জনকেও ছাপিয়ে উঠছিল। একপর্যায়ে মোড় ঘুরে আমার ট্যাক্সি বাঁয়ের আরেকটি সড়ক পথে যেতে শুরু করলো। এটি হলো পান্থপথ-তেজগাঁও লিঙ্ক রোড। এখানে এসে গাড়িচালক ইউটার্ন নিলেন। আর কয়েকবার চালাকি করে সড়কে জায়গা করে নিলেন। এখান থেকেই আমি হোটেলে যাবো। গলিপথটা খালিই ছিল। আমরা পার হলাম, আমাদের শেষ শ’ খানেক গজ পথ এবং এই প্রথম ফাঁকা সড়কের দৃশ্য দেখলাম। বিমানবন্দর থেকে হোটেলের আসার দূরত্ব ছিল সাড়ে ৮ মাইল। কিন্তু এতে সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। হোটেলের প্রবেশপথে এগিয়ে গেলাম। গাড়িচালক নিজের রায় জানালো: ‘আরে সামান্য ট্রাফিক, অতটা খারাপ নয়।’ ২০০০ সালে সাংবাদিক উইলিয়াম ল্যাঞ্জভিশে লিখেছিলেন, ‘দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির মতো দেশ নয় বাংলাদেশ।’ কথাটা অতিরঞ্জিত শোনালেও ঢাকার সড়কে এমন আটকে থাকাটা হলো দুর্দশাকে চাক্ষুষ করা। রাজধানীর নিশ্চল সড়ক দেশের সবচেয়ে বড় দুর্দশা তথা জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতীক। উন্নয়নশীল বিশ্বের মানদণ্ডে এ বৃদ্ধিকে মোটামুটি বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় এটি ভয়াবহ। মূলত, ট্রাফিক হলো ঘনত্বের ইস্যু। যখন খুব অল্প জায়গায় অনেক বেশি মানুষকে নাড়াচড়া করতে চায়, তখন এটি হবেই। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১২তম। কিন্তু প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এটি এ তালিকার সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ও সবচেয়ে দারিদ্র্যকবলিত দেশগুলোর শীর্ষে। একে অন্যভাবেও বলা যায়। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ রাশিয়ার ১১৮ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা রাশিয়ার চেয়ে আড়াই কোটি বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ঢাকায় এসে বেড়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, বাস্তবেই বলছি, ঢাকাই হলো বাংলাদেশ। দেশের সরকার, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের চাকরির বিশাল অংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। প্রতি বছর ঢাকায় ৪ লাখ নতুন বাসিন্দা এসে হাজির হয়। এই গণ-অভিবাসনের ফলে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটিতে পরিণত হয়েছে। এটি দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল নগরীগুলোরও একটি। যে শহরে এই কোটি মানুষের বসবাস, সেখানে মৌলিক অবকাঠামো ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি রয়েছে। অথচ, এগুলোই বড় শহরকে পরিচালনসাধ্য করে তুলে। পুরো ঢাকায় ট্রাফিক লাইটের সংখ্যা মাত্র ৬০টি। এরা সবগুলোই কমবেশি আলঙ্কারিক। খুব কম গাড়িচালকই এগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়। ঢাকার এই অরাজক সড়কগুলোর প্রধান সমস্যা হলো এগুলো পর্যাপ্ত নয়। ডেইলি স্টার জানিয়েছে, ঢাকার মাত্র ৭ শতাংশজুড়ে সড়ক রয়েছে। ১৯ শতাব্দীর নগর পরিকল্পনার মডেল যেসব নগরী, সেই প্যারিস বা বার্সেলোনায়ও এই হার ৩০ শতাংশ। ফুটপাথও একটি ইস্যু। ঢাকায় এগুলোর সংখ্যা খুবই বেশি। আর এগুলো অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। কারণ, এই ফুটপাথ দখলে রেখেছে হকার আর বসতিহীন দরিদ্র্য নাগরিকরা, যারা কুঁড়েঘরে ঘর বেঁধেছেন। ঢাকার মতো শহরে এ ধরনের যানজটের সাধারণ সমাধান হলো যাত্রীদের সড়কের নিচ দিয়ে চলাচল করানো। কিন্তু ঢাকার কোনো পাতালপথ নেই। একটি বানানোরও কোনো পরিকল্পনা নেই। পাশাপাশি মর্যাদার পরিচায়ক ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়তে থাকায় সমস্যা আরো জটিল হয়েছে। অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে গাড়িপ্রীতি ঝেঁকে বসেছে। ফলে প্রতি বছর শহরের সড়কে নামছে হাজার হাজার নতুন গাড়ি। সরকারের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার যানজট প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট করছে। শহরের অর্থনীতি থেকে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে শত কোটি ডলার। ঢাকাবাসীর জীবন ও মননের ওপরও ক্ষতিসাধন করছে ট্রাফিক। বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনার অধ্যাপক সরওয়ার জাহান বলেন, ‘শহরটি এখন পরমাণুতে পরিণত হয়েছে। মানুষ সামাজিকতা রক্ষা করতে পারছে না ট্রাফিক সমস্যার কারণে। আপনি মাঝে মধ্যে বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যেতে পারবেন। খুব বেশি সময় লাগে যেতে।’ অন্য কথায় বললে ঢাকার ট্রাফিককে অসুবিধা বলাটা ভুল। এমনকি সংকট বললেও কমই বলা হয়। আমেরিকার ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান মোরশেদ ঢাকার এ যানজটকে ‘একটি বিশাল নাগরিক রোগ’ বলে অভিহিত করেন, যেটি কিনা সময় খতম করেই যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করেছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি রাজধানী এই ট্রাফিক ও অবকাঠামো সমস্যার সমাধান না করতে পারে, এই অগ্রগতি অস্থায়ী হবে। এই অগ্রগতি নিজেই নিশ্চল হয়ে যাবে। যানজটে আটকা পড়া সড়ক ঢাকার যন্ত্রণার বড় চিত্র। এটিই হয়ে উঠতে পারে শহরটি একমাত্র রোগ। ঢাকার ট্রাফিক জট ইন্দ্রিয়েও আঘাত করে। আপনি এর গন্ধ পাবেন, স্বাদ পাবেন। গাড়ির ধোঁয়া আপনার নাকে সুড়সুড়ি তৈরি করবে। জিহ্বায় এক ধরনের এসিডের স্বাদ সৃষ্টি করবে। কিন্তু এ ট্রাফিক আপনার কানে বেশি আঘাত করবে। অনেক ইতিহাসবিদের দাবি, এ শহরের নাম এসেছে ‘ঢাক’ শব্দটি থেকে, যেটি কিনা এক ধরনের বাদ্য যা শব্দ তৈরি করে। সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক না কেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আপনার শ্রবণেন্দ্রিয়তে বেশ ভালোই নাড়া দেয়। ট্রাফিক হলো ঢাকার কানে তালা লাগানো গান। একটি বেসুরো থিম সং, যাতে আছে গাড়িচালকের চেঁচামেচি, ইঞ্জিনের গর্জন, হর্নের আওয়াজ। এই তালা লাগানো শব্দ হচ্ছে আগ্রাসনের শব্দ। ঢাকার গাড়িচালকরা সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে দয়াহীন আর নিষ্ঠুর। তারা হতে পারে দুনিয়ার সবচেয়ে সেরাও, যদি ঢাকার প্রচলিত বেআইনি ও বিপজ্জনকভাবে গাড়িচালনাকে দক্ষ গাড়িচালনা হিসেবে আপনার মনে হয়। এক বিকালে আমি শের-এ-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কাছে অটোরিকশায় চড়লাম। শহরের সবচেয়ে যানজটের সড়কগুলোর একটির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ আর আঁকাবাঁকা যাত্রা শেষ করলাম। ঢাকাইয়ারা অটোরিকশাকে সিএনজি বলে ডাকে। কারণ, তারা কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসে চলে। এগুলো হলো এমন ধরনের যান, যা আপনি এশিয়ার তাবৎ নগরে পাবেন। এতে থাকবে ছোট ধাতব বক্স, চলবে তিন চাকায় আর বিভক্ত দুটি ভাগে। এক ভাগে বসেন চালক, আরেক ধাপে বসেন যাত্রীরা। যাত্রীদের খোপ কিছুটা বড়, কিন্তু তবুও বেশ সরু। এগুলো ঘন সবুজ রঙে রাঙ্গানো। কিন্তু প্রায় সবগুলোই নোংরা আর একই ধরনের। খুব বেশি শব্দ করে এই অটোরিকশা। অপরিচ্ছন্ন এ যানকে অনেকটা গলফ কার্টসের কাজিন বলা যেতে পারে। আমার সিএনজি চালক হলো বেশ গম্ভীর এক ব্যক্তি। ২০ বছরের কোঠায় শেষের দিকে তার বয়স। সড়কে তিনি রীতিমতো ক্লান্তিহীন। এক সেন্টিমিটার খালি রাস্তাও ছাড় দিতে রাজি নন তিনি। যখনই ট্রাফিক একটু হালকা হয়, যত দ্রুত সম্ভব তিনি সামনে এগিয়ে যান। আমরা তখন শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম অংশে ছিলাম। সেটি হলো বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম সরণি। চড়া এ সড়কের দু ধারে শপিংমল আর ক্রেতায় ভর্তি। আরেকটা মল-টাইপ কিছু রাস্তাই দখল করে ফেলেছে! ঢাকায় যানজট আবার কিছু টাকা রোজগারের উপায়ও। যখন সড়কে গাড়ি আটকে যায়, হকাররা পানির বোতল, শসা, বই বিক্রি করতে ছুটে আসে। আবার অপরাধও এখানে একটা ইস্যু। এক সময় সিএনজিগুলোতে কোনো দরজা ছিল না। কিন্তু এখন দরজা লাগানো হয়েছে, যাতে ছিনতাইকারীরা ছোঁ মেরে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে না পারে। এরা নিশ্চল যানজটেই বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই উদ্যমী চোরের দল প্রায়ই সিএনজির উপরে উঠে ছাদের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এরপর কিছু নিয়ে যায়। কেউ যাতে পিছু না নিতে পারে, এ জন্য ভিকটিমের চোখে টাইগার বাম মেরে পালায়। তবে আমার চালকের ধ্যানজ্ঞান হলো সিএনজিকে দৌড়ের ওপর রাখা। ত্রাহি ত্রাহি দশাতেও সে এতে অটল। হর্ন বাজিয়ে অন্যদের হটিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে সে। গাড়িঘোড়ার মাঝে নাক ঢুকিয়ে দিয়ে, অন্য গাড়িচালকদের থামতে বাধ্য করে এগোচ্ছে। এক ইঞ্চি সামনে যাওয়ার সুযোগ পেলেও ছাড়ছে না। তিনি দুই শব্দই বারবার আওড়াচ্ছিলেন। যখনই হর্ন বাজাচ্ছেন, এই ফাঁকে পাশের গাড়িচালকদের দিকে চিৎকার করে বলছেন: ‘আস্তে!’ এই ‘আস্তে আস্তে!’ করেই তিনি এগিয়ে গেলেন অনেকদূর। পরে এক বাঙালি বন্ধুকে এ শব্দের মানে জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো, আস্তে শব্দের অর্থ হলো ‘ধীরে’। ঢাকায় এক ধরনের গাড়িকে কেবল কিছুটা ভদ্রস্থ মনে হয়। অন্তত শহরের ধাতবকঠিন মানদণ্ডে। সেগুলো হলো রিকশা। পুরো শহরে এই যানের মতো অদ্ভুত আর সর্বব্যাপী গাড়ি আর নেই। শহরের রিকশা বহরের আকার কত হবে তার কোনো ধারণা নেই কারও। এগুলোর অল্প ক’টিই নিবন্ধিত। ধারণা করা হয়, এই রিকশার সংখ্যা হবে ২ লাখের কাছাকাছি। অনেকের ধারণা, এই সংখ্যা আরো কয়েকগুণ হবে। রিকশা নিষিদ্ধে অনেক প্রস্তাব আনা হয়েছে। কিন্তু এ চেষ্টা সফল হয়নি। অনেকের যুক্তি, যানজটে কাহিল এ শহরে এই রিকশাই একমাত্র উপযুক্ত আর পরিবেশবান্ধব যান। কিন্তু অন্যরা বলছেন এগুলো কার্যকর নয়। কারণ, চারটি রিকশা একত্র করলে যে জায়গা হয় তাতে একটি ছোটখাটো বাস দাঁড় করানো যায়। আর চার রিকশায় বড়জোর ৮ জন বহন করা যায়। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত। সেটা হলো ঢাকার রিকশা দেখতে বেশ দারুণ। এগুলোকে বলা হয় চলন্ত জাদুঘর। এগুলোর পেছনে রঙিন বিভিন্ন পেইন্টিং। ফুলের কিংবা মুভি তারকার পোট্রেট। অথবা পেইন্টিংয়ে থাকে ‘৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বসূচক বিভিন্ন ছবি, আছে নাগরিক দৃশ্যও। রিকশার পেছনের এই পেইন্টিংগুলোর যেগুলোতে শহরের দৃশ্য থাকবে, সেখানে এক ধরনের পরিহাস দেখতে পাবেন। ওই শহর দেখতে শান্ত আর স্বপ্নীল। পাখি উড়ছে, উঁচু ভবনের পেছনে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। আর পেইন্টিংয়ে যেসব সড়ক আঁকা থাকে, সেগুলো অনেক পরিচ্ছন্ন, চওড়া, শান্ত আর যানজটশূন্য। ঢাকা শহরে হরহামেশাই চোখে পড়বে এসব রিকশা পেইন্টিং। বিশেষজ্ঞদের কাছে ঢাকা শহরের অন্যতম যন্ত্রণা ট্র্যাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণের সমাধান চাইলে তারা একই বুলি আউড়ে যান। তারা বলেন ট্রাফিক লাইটের কথা, রিকশার জন্য পৃথক লেনের কথা, পৃথক পৃথক লেনের কথা, হালকা রেললাইনের কথা। তারা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেন, বলেন চট্টগ্রাম বা খুলনার মতো শহরের উন্নয়ন করতে যাতে ঢাকা থেকে বোঝা কমানো যায়। সরকার তার দিক থেকে ১২ মাইল দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ হাতে নিয়েছে। গত আগস্টে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১১৪ কোটি মার্কিন ডলার। তবে ঢাকায় এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে সংশয় রয়েছে, যেখানে সরকারের অযাচিত আচরণ ও দুর্নীতির কারণে অনেক সময়ই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে যায়। রাজধানীর রাস্তাগুলো গিজ গিজ করে। ঢাকার এই রাস্তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং শহরটির অলঙ্ঘনীয় রাস্তাগুলোর প্রতি মমতা জন্মাতে সময় লাগে না। শহরে নতুন কারো কাছে শহরটির ট্রাফিক একটি ভিনগ্রহের শহরের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল জমে থাকা গাড়ির দীর্ঘ বহর। চারপাশজুড়ে এ দৃশ্য স্থান ও প্রেক্ষিতের সব ধারণা বদলে দেয়। এ যেন কিউবিজম ধারার কোনো শিল্পীর কাজ। এর প্রশংসা করতে আমি শিখে গিয়েছিলাম। এই দৃশ্যে রয়েছে ছিটিয়ে দেয়া রঙের কারুকাজ, দেয়ালে অঙ্কিত চিত্রকর্মের ছোঁয়া, কোনো ট্রাকের রেয়ারভিউ আয়নায় চালকের দাঁড়ির এক ঝলক, পরাবাস্তবতার মতো মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে ঝুলতে থাকা ভাঁজ হয়ে যাওয়া ধাতবের স্তূপ, কোনো অদেখা ত্রিচক্রযানের সামনের অংশ। আমি অবশ্যই জানতাম, বিশ্বের অন্যতম ধনী একটি শহর থেকে আগত কোনো দর্শনার্থীর পক্ষে অন্যতম দরিদ্র একটি শহরের কোলাহল ও অকার্যকর ব্যবস্থার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলাপ করাটা শোভন নয়। ঢাকার ট্রাফিক কেবল বিড়ম্বনা নয়। এটা দারিদ্র্য, এটা অবিচার, এটা দুর্দশার চিত্র। তারপরও ঢাকায় যাদের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে, আমি ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এটা কারও কাছে অগ্নিপরীক্ষা, কারও কাছে সাহসী পদক্ষেপ, কারও কাছে ভয়ানক কিছু। এটা কারও কারও কাছে যুক্তিহীনভাবে গর্বেরও। আজীবন ঢাকায় থাকা এক নারী আমাকে বলেছিলেন, প্রবাসে থাকার সময় তিনি ‘যানজট খুব মিস করতেন’। ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় শহরে ভিড় না থাকার বিষয়টিই তাকে বিচলিত করে তুলতো। একটা দিন আপনি ঢাকায় পার করলে, আপনি যখন কোনো জট পাকানো দুই রাস্তার সন্ধিস্থল অতিক্রম করবেন, এটা যেন সব অসম্ভবের বিরুদ্ধে জয়। ঢাকা আপনাকে মনের এক দার্শনিক অবস্থায় উপনীত করবে। ঢাকা শেখাবে, ভ্রমণ করাটা নরকতুল্য। সেই সঙ্গে আপনাকে মনে করিয়ে দেবে ভ্রমণের সেই আদিম বিস্ময়ের কথা, সেই আদিম সত্যের কথা- প্রাত্যহিক হোক বা না হোক, কোনো একটি সফর শেষ করার অর্থই হলো একটি স্থানকে জয় করা; সময়কে পরাভূত করেই। ঢাকায় এটা কেবল হয়তো নির্ভর করবে মিরপুর রোডে যানবাহনের উপস্থিতি কতটা বেশি রয়েছে। নিউ ইয়র্কে ফেরার দিন যখন এলো, ঢাকায় ততদিনে যথেষ্ট পরিমাণ দিন কাটাতে পেরেছি। এই সময়টা বিনিময়ের ওই নীতি শেখার জন্য যথেষ্ট ছিল, যাতে বলা হয়েছে, তাড়াতাড়ি বের হও। আমি তাই আমার ফ্লাইটের বোর্ডিংয়ের সময়েরও ৫ ঘণ্টা আগে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে রাখি। সেটা ভোর পৌনে পাঁচটায়। আমি তবুও বিচলিতভাবে একটি অপেক্ষমাণ ট্যাক্সিতে চড়ে বসি। ওই ট্যাক্সির চালক আমাকে নিশ্চিন্ত করেন, এই সময়ে যানজটের পরিস্থিতি ততটা খারাপ হবে না। তার কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। তখনও সূর্য ওঠেনি। ঢাকার কালো সড়কের ওপর দিয়ে প্রচণ্ডবেগে ধাবিত হতে থাকে আমার ট্যাক্সি। কোনো যানজট নেই রাস্তায়, একেবারেই শূন্য রাস্তা, ফাঁকা। এয়ারপোর্ট রোডে আমরা পৌঁছলাম। তখনও এতটুকু কমেনি আমার ট্যাক্সির গতি। আমি ট্যাক্সির ড্যাশবোর্ডে স্পিডোমিটারে নজর রাখলাম যে কিলোমিটারের কাঁটা কোথায় পৌঁছায়। আমি আমার জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম। ট্যাক্সির গতি তখন ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার পেরিয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল, যেন উড়তে উড়তে যাচ্ছি। এরপর আমাদের গন্তব্য থেকে যখন মাইলখানেক দক্ষিণে রয়েছি, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল প্রাইভেট কার, ট্রাক ও সিএনজির এক গাড়িবহর। কমে গেল ট্যাক্সির গতি। আমরা উড়ন্ত অবস্থা থেকে নেমে এলাম মাটিতে, ঢাকার চিরচেনা জ্যামে ঠাসা রাস্তা। চিরাচরিত নিয়ম মেনে আমরা থামছিলাম, আবার চলছিলাম, আবার থামছিলাম। যানবহরের ওই ভিড়ের কোনো কারণ স্পষ্ট জানতে পাইনি। কিন্তু এটা নিশ্চিত ছিল যে, ফ্লাইট ধরতে আমার কোনো সমস্যা হবে না। আমি তাই নিরুদ্বেগই ছিলাম। শেষ একবারের মতো যানজটের এই উন্মত্ততা উপভোগই করার মনস্থ করলাম। অবশেষে ট্যাক্সির স্পিডোমিটারের কাঁটা ঘণ্টায় ৫ মাইলের দিকে এগিয়ে গেল। আর আমরাও ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ঠিক তখনই মনে খেলে গেল একটি চিন্তা, ঠিক যেন ঢাকা শহর তার করণীয়টা আমার ওপর প্রয়োগ করে দিয়েছে। এটা কি যানজট? আরে নাহ, এটা কোনোভাবেই যানজট নয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস স্টাইল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.