যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রথম মুখোমুখি বিতর্কে নিজেকে যোগ্য প্রমাণে সফল হতে পারেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৯৫ মিনিট স্থায়ী এই বিতর্কে হিলারি ক্লিনটন কেবল অধিক প্রস্তুত ও অভিজ্ঞ প্রার্থী হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন তা নয়, দেশের প্রেসিডেন্ট হতে হলে যে মেজাজ দরকার, সেটি তাঁর আছে, সে কথাও প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
বিতর্ক-পরবর্তী তাৎক্ষণিক জনমত জরিপে এ কথা বেরিয়ে এসেছে। সিএনএনের এই জরিপে দর্শকদের ৬২ শতাংশ বলেছেন যে বিতর্কে জয়ী হয়েছেন হিলারি। মাত্র ২৬ শতাংশ মনে করেন জয়ী হয়েছেন ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকদের চোখে তিনিই জয়ী।
বাংলাদেশ সময় গতকাল মঙ্গলবার সকালে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে বিতর্কে অংশ নেন হিলারি ও ট্রাম্প। এনবিসি টেলিভিশনের উপস্থাপক লেস্টার হল্ট বিতর্ক সঞ্চালনা করেন।
বিতর্কের প্রথম ২০-২৫ মিনিট ট্রাম্প মোটামুটি তাঁর পরিকল্পনামতোই এগোচ্ছিলেন। শুরু থেকেই তাঁর মনোযোগ ছিল হিলারি ও ওবামার মতো ‘পেশাদার’ রাজনীতিকদের কারণে আমেরিকার অর্থনীতির যে হাল হয়েছে, তার এক করুণ ছবি তুলে ধরা। তিনি হিলারির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভার ব্যবহারের মতো ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে তাঁর অযোগ্যতার প্রমাণ, সে বিষয়ে জোর দেন।
এসব প্রশ্ন যে উঠবে, হিলারি সে কথা জানতেন এবং প্রতিটি প্রশ্নের মোক্ষম উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, বিশেষত যে করনীতি তিনি প্রস্তাব করেছেন, তাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের বক্তব্য ও পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে হিলারি বলেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ট্রাম্প ও তাঁর পরিবারের মতো ধনিক শ্রেণিই লাভবান হবে। ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতি’ আগে কাজ করেনি, এখনো কাজ করে না।
বিতর্কের অধিকাংশ সময় ট্রাম্প নিজেকে আত্মরক্ষায় ব্যয় করেন। হিলারি ও তাঁর প্রস্তাবিত নীতি নিয়ে আক্রমণের বদলে বিভিন্ন প্রশ্নে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যাতেই তিনি অধিক সময় নেন। ওবামার জন্মস্থান আমেরিকায় নয়, সে কারণে তিনি এ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আইনগত যোগ্যতা রাখেন না—এই অভিযোগ তুলে গত পাঁচ বছর কাটিয়েছেন ট্রাম্প। দুই সপ্তাহ আগে তিনি স্বীকার করেন যে ওবামা আমেরিকাতেই জন্মেছেন। হিলারি সে কথা উল্লেখ করে ট্রাম্পকে বর্ণবাদী হিসেবে চিত্রিত করে বলেন, এ-জাতীয় বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহারে তাঁর দীর্ঘ রেকর্ড রয়েছে। এই আক্রমণের জবাবে ট্রাম্প, ‘ভুল ভুল’ বলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন, নিজের পক্ষে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ দিতে পারেননি।
ইরাক যুদ্ধের শুরুতে এই যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন ট্রাম্প, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন হিলারি। জবাবে ট্রাম্প বারবার বলতে থাকেন, ‘সে কথা সত্য নয়।’ যদিও হিলারির কথার সত্যতা নিয়ে কারও মনেই কোনো সন্দেহ নেই।
হিলারির জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর সময় ছিল যখন ব্যক্তিগত সার্ভারে তাঁর ই-মেইল ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ট্রাম্প। হিলারি কোনো ওজর-আপত্তি ছাড়াই মেনে নেন ‘সেটি ভুল ছিল’। এ নিয়ে তিনি কোনো বাদ-প্রতিবাদ করবেন না। এর আগে এই ই-মেইল প্রশ্নে হিলারি পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন, যার ফলে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু বিতর্কের সময় সরাসরি নিজের ভুল মেনে নেওয়ায় এবং চতুর কোনো যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা না করায় এই প্রশ্নে দীর্ঘ বাদানুবাদের সুযোগ ট্রাম্পের হাতছাড়া হয়ে যায়।
গোড়া থেকেই হিলারির লক্ষ্য ছিল ট্রাম্পের সততা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ট্রাম্প নিজেকে সফল ব্যবসায়ী দাবি করলেও এই ব্যবসা তিনি শুরু করেছিলেন বাবার কাছ থেকে ১৪ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে। হিলারি এ কথা বলায় বিব্রত ট্রাম্প নানাভাবে প্রতিবাদের চেষ্টা করেন।
নিজের ব্যবসায় ট্রাম্প কর্মচারীদের দিয়ে কাজ করিয়ে বেতন দিতে অস্বীকার করেছেন, হিলারি এমন অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, বিতর্ককক্ষেও তেমন একজন স্থপতি রয়েছেন, যিনি কাজ করে পয়সা পাননি। কার্যত সেই অভিযোগ মেনে নিয়ে ট্রাম্প পাল্টা মন্তব্য করেন, ‘হতে পারে সেই লোক তেমন ভালো কাজ করেনি।’
হিলারি অভিযোগ করেন, ট্রাম্প তাঁর আয়কর হিসাব দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েছেন, অথচ গত ৪০ বছরে সব প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এ হিসাব দাখিল করেছেন। এর কারণ সম্ভবত এই যে তিনি আমেরিকার জনগণের কাছ থেকে একটা কিছু লুকাচ্ছেন। এমন হতে পারে যে তিনি আসলে তেমন ধনী নন অথবা তিনি কোনো আয়করই দেন না। হিলারির এসব মন্তব্যের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘এ থেকে প্রমাণিত হয়, আমি আসলে অত্যন্ত “স্মার্ট”।’
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতেও ট্রাম্পের প্রতি জোরালো আঘাত হানতে সক্ষম হন হিলারি। তিনি দর্শকদের মনে করিয়ে দেন, ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে চীনাদের নিজের স্বার্থে বানানো একটি ‘মিথ্যা কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। জবাবে ট্রাম্প সজোরে মাথা নেড়ে বলেন, ‘ভুল, আমি এ কথা বলিনি।’ ট্রাম্প যে একবার নয়, প্রায় আধা ডজনবার সে কথা বলেছেন, তার প্রমাণ অবশ্য ট্রাম্পের নিজের বিভিন্ন টুইটার বার্তায় রয়েছে।
ট্রাম্প যে নারীদের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা বলতে অভ্যস্ত, হিলারি জোরালোভাবে সে কথাও তুলে ধরেন। ট্রাম্প কিছুদিন আগেও হিলারির সমালোচনা করে বলেছিলেন, তিনি দেখতে মোটেই প্রেসিডেন্টসুলভ নন। সে কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিলে ট্রাম্প প্রথমে বলেন, ‘হিলারির চেহারা প্রেসিডেন্টসুলভ নয়।’ পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে বলেন, হিলারির যথেষ্ট কার্যক্ষমতা বা স্ট্যামিনা নেই। সে কথার জবাবে হিলারি মৃদু হেসে বলেন, ট্রাম্প যখন তাঁর মতো ১১২টি দেশ সফর করবেন এবং একের পর এক কূটনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করবেন বা সিনেটে একটানা ১১ ঘণ্টা জেরার সম্মুখীন হবেন, শুধু তারপরই ‘স্ট্যামিনা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন। এ সময় পুরো হল সজোরে হেসে ওঠে।
ট্রাম্প যে এই বিতর্কের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি, সে কথা প্রথম থেকেই চোখে পড়ে। হিলারির লক্ষ্য ছিল ট্রাম্পের নিজের কথা ব্যবহার করে তাঁকে বিচলিত করে তোলা। খুব সহজেই তিনি হিলারির পাতা এই ফাঁদে পা দিয়ে বসেন। প্রথম কয়েক মিনিট পরই তাঁর মুখের স্মিত হাসি মিলিয়ে যায় এবং তিনি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। ৯৫ মিনিটের বিতর্কের সময় তিনি কমপক্ষে ৫১ বার হিলারিকে কথা বলতে বাধা দেন এবং বার ছয়েক ঢক ঢক করে পানি খান। বোঝাই যাচ্ছিল একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণের কারণে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছেন।
ট্রাম্প কতটা খেই হারিয়েছিলেন, তার প্রমাণ মেলে বিতর্কের প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে তিনি দাবি করেন, তাঁর প্রধান গুণই হলো শান্ত মেজাজ বা টেম্পারামেন্ট। মুখ কুঁচকে ও অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে তিনি এ কথা বলেন। তাঁর সে কথায় হলে হাসির রোল ওঠে। নিজের মেজাজের প্রশংসা যখন তিনি নিজেই করেন, তাতে যে কিছু খাদ আছে, সে কথা দর্শকদের বুঝতে কষ্ট হয়নি।
নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা একমত, গত দুই সপ্তাহে নির্বাচনী প্রচারণাকে ট্রাম্প যেভাবে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হন, এই বিতর্কের ফলে হিলারি সম্ভবত তার গতিপথ আটকে দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিতর্কের আগে নেওয়া জনমত জরিপ অনুসারে ট্রাম্প ও হিলারির জনসমর্থন কার্যত সমান। তবে এই এক বিতর্কের ফলে সেই হিসাব পুরো উল্টে গেল, এ কথা কেউ বলে না। হিলারির জন্য ভালো খবর, স্বতন্ত্র ভোটারদের একাংশ—সিনএনএনের হিসাবে প্রায় ৩৪ শতাংশ—হিলারির পক্ষে ভোট দিতে প্রস্তুত বলে প্রাথমিক জনমত জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবে রিপাবলিকান ভোটারদের কেউ তাঁদের অবস্থান বদলেছেন, সে কথা মনে হয় না।
হিলারি-ট্রাম্প আরও দুবার পরস্পরের মুখোমুখি হবেন। প্রথম বিতর্ক থেকে শিক্ষা নিয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতিসহ লড়তে নামলে ট্রাম্প যে ঘুঁটি উল্টে দেবেন, তাঁর রিপাবলিকান সমর্থকেরা এখন কেবল সেই আশাই করতে পারেন। ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ভাষ্যকার জেফ্রি লর্ড মনে করিয়ে দিয়েছেন, এক মাঘে শীত যায় না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.