হিডেন চার্জের নামে গ্রাহকের টাকা সাবাড় করছে বেশ কিছু অসাধু ব্যাংক
একজন গ্রাহক চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি সেভিং অ্যাকাউন্ট খোলেন সিটি ব্যাংকে। পরে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যেতে আরও একটি ‘স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট’ খোলেন তিনি। খোলার সময় অ্যাকাউন্টে রাখা হয় ৭ হাজার টাকা। বর্তমানে তার অ্যাকাউন্টে আছে মাত্র ৬২৮ টাকা। এর মধ্যে শুধু এসএমএস রেজিস্ট্রেশন বাবদই কেটে নেয়া হয় ৩৪৫ টাকা। যা গ্রাহক জানেন না। এ ছাড়া বাকি টাকা ফরেন ফাইল খোলা বাবদ কাটা হয়েছে। যা নির্ধারিত সেবা চার্জের তুলনায় অনেক বেশি। এটি গ্রাহক জানতে পারেন তখন, যখন সব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। শুধু সিটি ব্যাংক নয়, এভাবে প্রায় ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে গোপন চার্জ কাটার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার সময় সার্ভিস চার্জের কোনো পরিমাণ উল্লেখ থাকে না কোথাও। বরং ওই আবেদনে শুধু বলা হয়, যে সেবা গ্রহণ করবেন তার পাশে টিক চিহ্ন দিন। এভাবে সার্ভিস চার্জের বিষয়ে গ্রাহকরা অন্ধকারে থাকেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সার্ভিস চার্জের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট গাইডলাইন আছে। কিন্তু ছোটখাটো নানা বিষয়ে ব্যাংকগুলো চার্জ আদায় করে। এমনকি হিডেন চার্জও রয়েছে। এতে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে হিডেন ইনকাম বা অদৃশ্য আয় বেড়ে গেছে। অনেক ব্যাংক লাভে নেই, কিন্তু ভালো চলছে। গোপন আয়ের মাধ্যমে এসব টাকা সমন্বয় করা হয়। গ্রাহকের অজান্তে কেটে নেয়া হয় বেশ কিছু চার্জ। এতে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহক। কোনো কোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ উইন্ডো ড্রেসিং বা কৃত্রিম উপায়ে আয় বাড়িয়ে ব্যাংকের মূলধন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বেশি দেখায়। এতে কাগজে-কলমে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখালেও বাস্তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হয়ে উঠছে রুগ্ন।
বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ৮ থেকে ১০ রকমের গোপন চার্জ কাটা হচ্ছে। একটি ঋণ অনুমোদনে ১১ শতাংশ সুদের কথা উল্লেখ করা হলেও এটি ওভার ডিও হলে মূল সুদের সঙ্গে আরও ১ থেকে ২ শতাংশ বেশি সুদ কাটা হচ্ছে। অতিরিক্ত সুদের খবর গ্রাহক জানেন না। গ্রাহক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের যে কোনো কাজ তৈরি বা সম্পন্ন (প্রসেসিং ফি) করতে নেয়া হচ্ছে ১ থেকে ২ শতাংশ সেবা চার্জ, যা গ্রাহকের অজান্তে নেয়া হয়। ডকুমেন্ট সরবরাহ ফি বাবদ নেয়া হচ্ছে অনেক টাকা। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহক জানেন না। সুইফট মেসেজ পাঠাতে মূল খরচের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি সেবা চার্জ কাটা হচ্ছে। এটিও গ্রাহক জানেন না। প্রতি মাসে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট সরবরাহ ফি নেয়ার কোনো বিধান না থাকলেও ব্যাংকগুলো গ্রাহকের অজান্তে তাও কেটে নিচ্ছে। একইভাবে সেভিং অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট বছরে সরবরাহ করতে হয় দু’বার। এ জন্য কোনো ফি নেয়ার বিধান না থাকলেও অনেক ব্যাংক নিচ্ছে প্রায় ৫০০ টাকা। এসএমএস ফি নেয়ার বিধান নেই। তবুও এসএমএস ফি নিচ্ছে। এভাবে নানা গোপন কাটাকাটির শেষ নেই।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ব্যাংকার্স অব বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার যুগান্তরকে বলেন, হিডেন চার্জ ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের ক্রাইম। ব্যাংকিং সেবার চার্জ গ্রাহক জানেন না। অথচ নির্দিষ্ট সময়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে বড় অংকের টাকা। এ ধরনের অপরাধ বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে এখন অনেকাংশে কমে গেছে। আগে এটা বেশি ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে সেবা চার্জ দৃশ্যমান জায়গায় টাঙিয়ে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বহু আগে। সে ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সূত্র জানায়, মোবাইল অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনায় বার্ষিক কোনো চার্জ নেই। তবে এজেন্ট ও এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনে (ক্যাশ আউট) প্রতি হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা চার্জ দিতে হয়। বাস্তবে ২০ টাকার নিচে কোনো চার্জ নেই। ফলে কেউ ১০ হাজার টাকা কোথাও পাঠালে ২০০ টাকা চার্জ দিতে হয়। এ ছাড়া অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠাতে লাগে শতকরা ৫ টাকা, ইউটিলিটি বিল ও কেনাকাটার বিলে সর্বনিু ৫ টাকা থেকে ১ শতাংশ হারে চার্জ কাটা হয়। এসব চার্জের কারণে এই সেবায় খরচ অনেক বেশি। অথচ এগুলোতে ব্যাংকের খরচ কম।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকে কিছু হিডেন চার্জের অভিযোগ আছে। হিডেন চার্জ বন্ধে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ধরনের চার্জ কমাতে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। ব্যাংকার্স মিটিংয়েও সতর্ক করা হয়েছে। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা যায় না। তিনি মনে করেন, হিডেন চার্জ পুরোপুরি বন্ধ না হলেও দ্রুত কমে আসবে।
জানা গেছে, ব্যাংক ভেদে অনলাইনে হিসাব পরিচালনা করতে বার্ষিক ফি দিতে হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। অনলাইনে এক শাখা থেকে অন্য শাখার হিসাবে টাকা জমা দিতে সর্বনিু ২০ থেকে দেড় হাজার, টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চার্জ দিতে হয়। অনলাইনে ৫০ হাজার টাকার কম জমা দিতে চার্জ ২০ টাকা আর উত্তোলন করতে লাগে ৫০ টাকা। ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দেয়ার খরচ ৫০ এবং উত্তোলনের খরচ ১০০ টাকা। ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার চার্জ ১০০ এবং উত্তোলনের চার্জ ২০০ টাকা। ৫ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত জমা ও উত্তোলনে চার্জ ৩০০ টাকা। ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা জমা দিতে ৫০০ এবং উত্তোলনে ১ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ কেটে রাখে ব্যাংক। তবে কিছু ব্যাংক জমার ক্ষেত্রে কোনো চার্জ নেয় না।
অনলাইনের মাধ্যমে এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে টাকা স্থানান্তর করতে খরচ লাগে সর্বনিু ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে পে-অর্ডার, টিটি, ডিডি, সুইফট ইত্যাদি মাধ্যমে টাকা পাঠাতে ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি নেয়া হয়। এসব চার্জ কাটার খবর অনেক সময় গ্রাহক জানেন না।
ই-ব্যাংকিং হিসাবে বার্ষিক ফি ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ই-ব্যাংকিং নিরাপত্তার জন্য প্রবর্তিত সফটওয়্যার টোকেনের দাম ১৫০ টাকা, রিপ্লেসমেন্ট করতে লাগে ৩০০ টাকা। হার্ডওয়্যার টোকেনের দাম ১ হাজার ও রিপ্লেসমেন্ট চার্জ দেড় হাজার টাকা। এ জন্য মোবাইলে এসএমএস সেবা নিতে বার্ষিক চার্জ ২৫০ টাকা। এ ছাড়া অ্যালার্ট ব্যাংকিং রয়েছে। এর জন্য চার্জ বার্ষিক ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো ব্যাংকে এ সেবায় কোনো ফি নেই।
ক্লাসিক বা সাধারণ কার্ড ইস্যু করতে ফি নেয়া হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা, বার্ষিক ফি ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা, নবায়ন ফি ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা এবং পিন পরিবর্তন ফি ২০০ থেকে ৬০০ টাকা। সিলভার কার্ডের ইস্যু ফি এক থেকে দেড় হাজার, বার্ষিক ফি এক থেকে দেড় হাজার, রিপ্লেসমেন্ট ফি ৭০০ থেকে ১ হাজার এবং পিন পরিবর্তন ফি লাগে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। গোল্ড কার্ড ইস্যু ফি দেড় হাজার থেকে ২ হাজার, বার্ষিক ফি ২ হাজার থেকে ৩ হাজার, রিপ্লেসমেন্ট ফি ৭০০ থেকে ১ হাজার এবং পিন পরিবর্তন ফি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। ভিসা ও মাস্টারকার্ডের সব ধরনের ফি ৫০০ টাকা এবং পিন পরিবর্তন ফি ২০০ টাকা। ডেবিট কার্ড দিয়ে নিজস্ব ব্যাংকের বুথ থেকে লেনদেন করতে কোনো টাকা লাগে না। তবে পার্টনার ব্যাংক হলে ১৫ টাকা এবং নেটওয়ার্ক ব্যাংক হলে ৫০ টাকা ফি লাগে। অ্যাকাউন্টের মিনি স্টেটমেন্ট নিতে বা দেখতে ২ থেকে ৫ টাকা চার্জ লাগে।
ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে ভিসা ও মাস্টারকার্ডের বার্ষিক ফি সাড়ে ৪ হাজার, গোল্ড কার্ড আড়াই হাজার এবং ক্লাসিক কার্ডের দেড় হাজার টাকা। গোল্ড কার্ডে সাপ্লিমেন্টারি ফি ১ হাজার, পিন পরিবর্তন ৫০০ ও প্লাস্টিক ৩০০ টাকা। ক্লাসিক কার্ডের সাপ্লিমেন্টারি চার্জ ৬০০, পিন পরিবর্তন ৩৫০ ও প্লাস্টিক ২০০ টাকা। ক্রেডিট কার্ডে নগদ টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বা ১৫০ টাকা চার্জ কাটা হয়। ডলারে অর্থ নিলে ৩ শতাংশ বা ৫ ডলার চার্জ লাগে। সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করলে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানা এবং ৫ থেকে ১৫ ডলার জরিমানা কাটে ব্যাংক। অ্যালার্ট সার্ভিস চার্জ প্রতি মাসে ১০ টাকা। প্রিপেইড কার্ডের মধ্যে ভিসা গিফট ২০০, ভিসা ট্রাভেল ৫০০ এবং হজ কার্ডে ৩০০ টাকা ইস্যু ফি লাগে। কার্ড রিপ্লেসমেন্ট ফি ১০০, স্টেটমেন্ট ৫০, ভাউচার ২০০, সার্টিফিকেট ২০০ এবং কার্ড ক্লোজড করতে ১০০ টাকা বা ১ শতাংশ হারে চার্জ কাটে ব্যাংক।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.