চলতি বছরের নয় মাসে অন্তত পাঁচ কিশোরী উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন উত্ত্যক্তের শিকার নারীসহ অন্তত নয়জন। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৫০টি। উত্ত্যক্তের কারণে গত বছর ছয়টি হত্যা ও ১০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। আর এ ধরনের মোট ঘটনা ঘটে ৩২০টি। আইনি সহায়তা সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ২০১১ সালের পর থেকে দেশে এসব ঘটনা ধীরে ধীরে কমছিল, তবে প্রবণতাটি এখনো উদ্বেগজনক। এসব ঘটনায় সাজা হওয়ার নজির বিরল। সামাজিক প্রতিরোধেরও অভাব আছে। আসক ২০১০ সাল থেকে জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত খবর এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে উত্ত্যক্তকরণ বা যৌন হয়রানির ঘটনার বছরওয়ারি পরিসংখ্যান রাখে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্ত্যক্তের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১১ সালে, প্রায় এক হাজার। উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছিল ৩৩ জন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল পাঁচজন। আর উত্ত্যক্তকারীর হাতে খুন হয়েছিল ২৩ জন। পরের বছর থেকে উত্ত্যক্ত এবং এর জেরে আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনা কমতে শুরু করে।
চলতি বছর উত্ত্যক্তের জের ধরে পরপর কয়েকটি হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা সম্পর্কে আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক ও আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলেন, ২০১০-১১ সালের পর গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও সামাজিক আন্দোলনের কারণে সরকার অনেকগুলো ঘটনার দ্রুত বিচার করেছিল। এতে উত্ত্যক্তের ঘটনা, আত্মহত্যা ও হত্যার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছিল। এখন তাঁর ভয়, প্রবণতাটি আবার বেড়ে যাচ্ছে কি না।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০১০ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশে উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটেছে প্রায় তিন হাজার। উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১২৩ জন, আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ২০ জন। উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় খুন হন ৯৪ জন, যাঁদের মধ্যে উত্ত্যক্তের শিকার মেয়েদের স্বজনেরাও আছেন।
নীনা গোস্বামী বলেছেন, উত্ত্যক্তের মামলায় সাজা হওয়ার নজির খুব কম। এসব মামলা দ্রুত বিচারের আওতায় এনে উত্ত্যক্তকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে এ ঘটনা কমতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী সীমা বানু সিমি উত্ত্যক্তের কারণে ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেন। ঘটনার ১৫ বছর পার হয়ে গেলেও মামলাটির এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
ঢাকার পাঁচ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি আলী আজগর স্বপন বলেন, মামলার পর সাক্ষী পাওয়া যায় না। সাক্ষীর অভাবে এসব মামলার আসামিরা সাধারণত খালাস পেয়ে যান। আবার মামলার পর অনেক ক্ষেত্রে বাদীপক্ষ আসামিদের সঙ্গে অলিখিত আপস করে। পরে আদালতে আর আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন না।
নীনা গোস্বামীর আরও শঙ্কা, সামাজিক প্রতিরোধ কমে যাচ্ছে। নিহত স্কুলছাত্রী রিসার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেয়েটিকে অনেক দিন ধরেই উত্ত্যক্ত করা হচ্ছিল। অথচ পরিবার থেকে আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এসব ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা বাদ দিয়ে আইনের সহায়তা নিতে হবে, এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আত্মহত্যার প্রতিরোধ
উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে যারা আত্মহত্যা করছে, তাদের বেশির ভাগই কিশোরী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংগৃহীত ২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারী মেয়েদের বয়স ১২ থেকে ২৫। এদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সীই বেশি। তারা অনেকে নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রী। ওই প্রতিবেদনগুলোতে বেশির ভাগ উত্ত্যক্তকারীকে যুবক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এঁদের মধ্যে মধ্যবয়স্ক পুরুষও রয়েছেন। এই তালিকায় আত্মীয় থেকে শুরু করে সহপাঠী, গৃহশিক্ষক, প্রতিবেশী, বাড়িওয়ালার ছেলে ও পাড়ার মুদি দোকানদারও আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছেন, উত্ত্যক্তের শিকার মেয়েটির যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না থাকে, সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে না পায়, এমনকি অভিভাবকের কাছে জানালে উল্টো তাকে দোষারোপ করে, তখন মেয়েটি অসহায় বোধ করে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যু ছাড়া সে আর কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। আত্মহত্যা করে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, আত্মহত্যাকারীদের কেউ কেউ অনেক সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে। এ জন্য স্কুলে একজন মনোবিজ্ঞানী থাকা দরকার, যিনি শিক্ষার্থীদের সংকটকালে পরামর্শ দিতে পারবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সহায়তার জন্য মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের একটি ‘ফ্রি হেল্পলাইন’ আছে, নম্বর ১০৯২১। এ নম্বরে ফোন করে জানা গেল, শারীরিক নির্যাতন ও পারিবারিক সমস্যার কারণে সহায়তা চাওয়া হলেও উত্ত্যক্তের বিষয়ে কেউ ফোন করে না। যদিও এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে পরামর্শ ও আইনি সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলছেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কয়েকটি ধাপে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাঁর মতে, পরিবার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজনে বাবা-মাকে সন্তান পালন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আর সন্তানের মধ্যে আত্মহত্যার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের (মনোরোগ চিকিৎসক) কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর সমাজের মানসিকতা বদলানোর জন্য সচেতন উদ্যোগ দরকার।
সাল উত্ত্যক্তর আত্মহত্যা আত্মহত্যার প্রতিবাদ করায়
ঘটনা চেষ্টা খুন
২০১০ ৫৬৮ ৩৩ ৮ ২০
২০১১ ৯৮২ ৩৩ ৫ ২৩
২০১২ ৪৫৯ ১৬ ৩ ১৫
২০১৩ ২৭৩ ১৪ ২ ১১
২০১৪ ২৪১ ১৪ ২ ১৩
২০১৫ ৩২০ ১০ ০ ৬
২০১৬ ১৪৮ ৩ ০ ৬
(জানুয়ারি–জুন)
মোট ২৯৯১ ১২৩ ২০ ৯৪
সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.