ভারত ও পাকিস্তানের দুই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা গতকাল সোমবার কাশ্মীর সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা কমাতে রাজি হয়েছেন। তবে এরপরও কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমছে না। গতকাল পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সর্বদলীয় সভায় ‘ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে’ ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা এসেছে। সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর দেশটির তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর আগে গত রোববার রাতে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বারামুল্লায় সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শিবিরে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় এক সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু হয়। আহত হন অন্য এক জওয়ান। পরে সন্ত্রাসবাদীরা জনারণ্যে মিশে গেছে। দুই সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হলেও তাঁদের দেহ সোমবার বিকেল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বারামুল্লায় সন্ত্রাসী হানার সঙ্গে উরি আক্রমণের চরিত্রগত কিছু অমিল রয়েছে। চার সন্ত্রাসী বারামুল্লায় সেনা ও বিএসএফ ছাউনিতে ঢুকতে পারেনি। বাইরে থেকে গ্রেনেড ছোড়ে এবং গুলি চালায়। কাশ্মীরে বিএসএফের ইন্সপেক্টর জেনারেল বিকাশ চন্দ্র দিল্লিতে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, সাধারণ নাগরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা আক্রমণের পর রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়। বারামুল্লার পুলিশের কর্মকর্তা ইমতিয়াজ হুসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, জনবসতির কাছেই এই ঘাঁটির অবস্থান। সাধারণ মানুষের স্বার্থে নিরাপত্তারক্ষীরা তাই সেভাবে পাল্টা গুলি চালাতে পারেনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, গত বৃহস্পতিবারের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তান যে পাল্টা-আঘাত হানবে, তা জানাই ছিল। সীমান্তের ওপাশ থেকেও যে তারা গুলি বা মর্টার ছুড়বে, সেটাও জানা। সে কারণে বারামুল্লা আক্রমণ এমন কিছু অপ্রত্যাশিত নয়। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, এটাই নতুন বিষয়। বৃহস্পতিবার ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ঢুকে জঙ্গি আস্তানায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার দাবি করে। এরপর নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয় দুই দফায়। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে রোববার। দুই বৈরী প্রতিবেশীর চলমান উত্তেজনার মধ্যেই গতকাল দুই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোনালাপ হয়। গতকাল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ এ কথা জানান। তিনি বলেন, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসির জানজুয়া ওই আলাপে নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা কমানোর বিষয়ে একমত হন। সারতাজ আজিজ সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের ঐকমত্যের কথা জানালেও কাশ্মীর নিয়ে দুটি দেশের শীর্ষ পর্যায় কিন্তু নানা কর্মকাণ্ডে গতকালও তৎপর থেকেছে। চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সর্বদলীয় বৈঠক হয়। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সব কটি দল ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার কথা ঘোষণা করে ওই বৈঠকে। গতকালের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। বৈঠকে ঘোষণা করা হয়, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় বাহিনীর উসকানিমূলক গুলিবর্ষণ—এসব নিয়েই এ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে নওয়াজ শরিফ বলেন, এ বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এর মাধ্যমে পাকিস্তানের নেতৃত্বের যৌথ বার্তা পৌঁছে দেওয়া হবে। জাতিসংঘের উচিত কাশ্মীর প্রশ্নটিকে তুলে ধরা। কেননা, এর ফলে উপমহাদেশের শান্তি হুমকির মুখে পড়েছে। বৈঠকে সিন্ধু পানিচুক্তি, বেলুচিস্তান ও সর্বোপরি পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে ভারতীয় তৎপরতার নিন্দা করা হয়। সেই সঙ্গে সিন্ধু পানিচুক্তি পুনর্মূল্যায়নে ভারতীয় তৎপরতারও নিন্দা করা হয়। বৈঠকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টসহ (এমকিউএম) সব দলের নেতারা অংশ নেন। এদিকে গতকাল সকালে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেনাপ্রধান জেনারেল দলবীর সিং, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল সুনীল লানবা ও বিমানবাহিনীর প্রধান অরূপ রাহা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে তাঁদের বাহিনীর প্রস্তুতির বিষয়ে অবহিত করেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও গতকাল বৈঠক করেন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। সীমান্ত উত্তেজনা ও নিরাপত্তাজনিত প্রস্তুতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুজনের কথা হয়। উরি আক্রমণের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের যে দাবি জানিয়েছিল, অজিত দোভালের তদারকিতেই তা সম্পন্ন হয়। দোভাল গতকাল চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াং যেইচির সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কেউ মুখ খোলেননি। উরি আক্রমণের পর ভারতের প্রত্যাঘাত ভারতীয় রাজনীতির বিভেদকেও আপাতত মিটিয়ে দিয়েছে। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। রাহুল গান্ধী বলেছেন, এই প্রথম নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীসুলভ কোনো কাজ করলেন। অন্য বিরোধী দলগুলোও এই পরিস্থিতিতে দৃঢ়ভাবে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে সমর্থন জানিয়েছে। গতকাল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে অন্তত একশ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধ রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানকে যেভাবে জবাব দিয়েছেন, তাতে তাঁকে সেলাম করি।’ তবে কেজরিওয়াল সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।